বিজ্ঞাপনের বাজার ছিল এশিয়াটিকে জিম্মি, ভোল পাল্টাচ্ছেন কর্তারা

ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

আওয়ামী লীগের গেল ১৬ বছরের দুঃশাসনের সময় দেশের সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের বাজারও ছিল জিম্মি। আর এই কাজটি করে এসেছে বিপণন, যোগাযোগ ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি। হাসিনা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরে সরকারি ও বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ও প্রচার-প্রচারণার কাজগুলো বাগিয়ে নিয়েছে তারা। আর এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেছে কখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবার, কখনো বা বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের নাম। এভাবে বিগত বছরগুলোতে বিজ্ঞাপনের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে রাখে প্রতিষ্ঠানটি। বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাটের অভিযোগও আছে স্বৈরাচার সরকারের আশির্বাদপুষ্ট এশিয়াটিকের বিরুদ্ধে।

তবে সরকার পতনের পর পরই ভোল পাল্টিয়েছেন এশিয়াটিকের কর্তারা। গত ৫ আগস্ট তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদ ছেড়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। তবে একটানা সুবিধা নিয়ে আসলেও অবস্থা বেগতিক দেখে সরকারের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান এশিয়াটিকের কর্ণধার ইরেশ যাকেরও। আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে তাকেও দেখা যায়।

এমনকি, গত ৫ জুলাই কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে অনুষ্ঠিত সেতুটির সমাপনী অনুষ্ঠানের পিআর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে খরচ ধরা হয়েছিল ৫ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল ২০২২ সালের ২৫ জুন। সেই অনুষ্ঠানের কাজও পেয়েছিল এশিয়াটিক।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবেকমন্ত্রী সংস্কৃতিমন্ত্রী ও এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান নূর এবং কো-চেয়ারম্যান সারা যাকের ও তার ছেলে ইরেশ যাকেরের প্রভাবে কোনঠাসা হয়ে থাকতেন অন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থার লোকজন।

আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে আছে আরও গুরুতর অভিযোগ। নীলফামারী-২ আসনের এই সাবেক সাংসদ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে চারজন বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীকে র‌্যাবের মাধ্যমে ক্রসফায়ারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ নিয়ে সরব হচ্ছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থার লোকজন। ইতিমধ্যে প্রায় দুই দশক ধরে দেশের বিজ্ঞাপন শিল্প এশিয়াটিকের হাতে জিম্মী করার অভিযোগ তুলে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন তারা।

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয়তা পান আসাদুজ্জামান নূর এবং সারা যাকের। বিশেষ করে ‘অয়োময়’ নাটকের জুটি হিসেবে তারা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তারা গড়ে তোলেন বিজ্ঞাপন সংস্থা। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের কাছে ঘেঁষে এই খাতের বাজার নিয়ন্ত্রণে নেন তারা।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে শতাধিক ভারতীয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে সম্মাননা ও স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। তাতে প্রতিটি পদকে বিপুল পরিমাণে সোনা চুরি হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। সে সময় এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠান ও পদক বানানোর কাজটি করেছিল এশিয়াটিক।

শুধু তাই নয়, শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী রিসার্চ উইং-সিআরআইয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন এশিয়াটিকের আরেক মালিক ইরেশ যাকের। গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বড় বড় ইভেন্টের প্রচারের কাজ একচেটিয়াভাবে করেছে এশিয়াটিক। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোর বিজ্ঞাপন ও প্রচারের নামে প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ টাকা লোপাট করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এশিয়াটিক তাদের প্রতিষ্ঠান মাইন্ডশেয়ার, এম-বি-এ, ওয়েভামকার, এম-পাওয়ারের নাম দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন বাগিয়ে নিত।

বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শ্বেতপত্রে দেওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০২০ ও ২০২১ সালে মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ পায় এশিয়াটিক। ওই দুই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় এশিয়াটিকের কর্তারা।

অভিযোগ আছে, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ইরেশ যাকেরদের এশিয়াটিক গ্রুপ বিভিন্ন নামে বিগত ১৬ বছরে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, বিকাশ, মারিকো, রেকিট, কোকাকোলা, ডানো, কোলগেট, পেপসির মতো বড় বড় সব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া বাজেট কুক্ষিগত করে নেয়।

সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের প্রভাবে ক্রিকেট বোর্ডের হাজার কোটি টাকার মিডিয়া সম্প্রচার সত্ত্বও বাগিয়ে নেয় এশিয়াটিক।

স্থানীয় সরকারের ডেঙ্গু প্রতিরোধে শেখ হাসিনার আহ্বান সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল। প্রায় শতকোটি টাকা বাজেটের এই বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র সরকার অনুগত টিভি চ্যানেলগুলোতে দেদারসে চালানো হয়। এছাড়াও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সরকারিভাবে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানির মাধ্যমে টিভির রেটিং ডাটাও এশিয়াটিক এককভাবে কুক্ষিগত করে রাখে। রেটিংয়ের অজুহাতে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগও আছে।

এছাড়াও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে মুজিব একটি জাতির রূপকার চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ প্রচার দেশে এশিয়াটিক ও গ্রুপ এম পরিচালনা করেছে। এই ছবির ফিচার বিদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচার ও বিজ্ঞাপনের কাজ করে ফোরথট পি আর ও মাইন্ডশেয়ার। সিআরআই-এর সদস্য হিসাবে গত ১৬ বছরে প্রতিটি জয় বাংলা কনসার্টের অন্যতম আয়োজক ছিল এশিয়াটিক এম সি এল।

অবশ্য গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপনের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখলেও গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন শেখ রেহানার ছেলে ববির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইরেশ যাকের। শেখ হাসিনার পতনের পর বিগত দিনে শেখ পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে থাকা ছবি ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলেন ইরেশ।

একটি প্রথম সারির বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পুরো সময় এশিয়াটিকের বাইরে কারও যেন মুখ খোলার সুযোগ ছিল না। তারা নিজের খেয়ালখুশি মতো করেছে সবকিছু। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ নিতে নাজেহালও হতে হয়েছে।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আসাদুজ্জামান নূরের মোবাইলে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার ও গ্রুপ এম-এর মিডিয়া ম্যানেজার জামশেদ আলম মজুমদারকেও একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।