বাংলাদেশি ঠেকানোর যুদ্ধে নেমেছে ইতালির এক শহর

বাংলাদেশি ঠেকানোর যুদ্ধে নেমেছে ইতালির এক শহর

ইতালির মনফ্যালকন শহরের উপকণ্ঠে প্রখর রোদে বাংলাদেশের কিছু ছেলে ছোট পিচে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছে। এই জায়গাটি শহর থেকে দূরে, ট্রিস্ট বিমানবন্দরের কাছে। এই ছেলেগুলোর শহর থেকে দূরে এসে ক্রিকেট খেলার কারণ— শহরের মেয়র ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ করেছেন। 

কেউ নিষেধাজ্ঞা ভাঙার চেষ্টা করলে ১০০ ইউরো জরিমানা করা হবে। 

দলের অধিনায়ক মিয়া বাপ্পী বলেন, আমরা যদি শহরের ভেতরে খেলতাম, এতক্ষণে পুলিশ এসে আমাদের থামিয়ে দিত। কিছু দিন আগে স্থানীয় একটি পার্কে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ধরা পড়ে বাংলাদেশের কয়েকজন যুবক। তারা জানত না যে, তাদের খেলা ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে। এর জন্য পুলিশ তাদের জরিমানা করে। 

তিনি আরও বলেন, তারা বলে ক্রিকেট ইতালির খেলা নয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে চাই, আমরা বিদেশি বলেই এমনটা হচ্ছে।  

ক্রিকেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা মনফ্যালকন শহরে যে উত্তেজনা তৈরি করেছে তা সামনে এনেছে। এই উত্তেজনা বাড়ছে।

এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এর এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ বিদেশি। এদের অধিকাংশই আবার বাংলাদেশি মুসলিম। এই বাংলাদেশি মুসলমানরা ১৯৯০ এর দশক থেকে এখানে আসতে শুরু করেন।

শহরের কট্টর ডানপন্থী মেয়র আনা মারিয়া বলছেন, শহরের সাংস্কৃতিক পরিচয় বাইরের লোকজন হুমকির মুখে ফেলেছে।

নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই মারিয়া অভিবাসনবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এটিকে তার শহর এবং খ্রিস্টান মূল্যবোধ রক্ষার একটি ‘মিশন’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। 

মারিয়া বলেন, আমাদের ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা কিছুই না। সবকিছুই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। 

এই শহরে ইতালির নাগরিকদের দেখা যায় পাশ্চাত্য পোশাকে। সালোয়ার ও হিজাবে বাংলাদেশি নারীদের দেখা যায়। শহরে বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট ও হালাল দোকান রয়েছে। এখানে সাইক্লিং পাথ রয়েছে, বেশিরভাগই দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা ব্যবহার করে।

শহরের যে অংশে অধিকাংশ বাংলাদেশি বসতেন, সেখান থেকে বেঞ্চগুলো সরিয়ে ফেলেছেন মেয়র মারিয়া। সমুদ্রের তীরে মুসলিম নারীরা যে পোশাক পরেন, তার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছেন তিনি।

মেয়র মারিয়া বলছেন, এখানে ইসলামী মৌলবাদের একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া রয়েছে। 

মুসলিমদের নিয়ে নিজের অবস্থানের জন্য মেয়রকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তিনি এখন ২৪ ঘণ্টা পুলিশি নিরাপত্তায় রয়েছেন।

মিয়া বাপ্পী ও তার সতীর্থ ক্রিকেটাররা চাকরির জন্য ইতালিতে এসেছিলেন। জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি ফিনকান্তেরিতে কাজ করতে এসেছিলেন এই মানুষগুলো। কোম্পানিটি ইউরোপের বৃহত্তম জাহাজ কোম্পানি এবং বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি।

এই কোম্পানিটিকেও মেয়র মারিয়া টার্গেট করেছেন। তিনি বলছেন— কোম্পানি এত কম বেতন দেয় যে কোনো ইতালিয়ান কাজ করবে না। 

তবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ক্রিশ্চিয়ানো বাজারা বলছেন, যে অর্থ দেওয়া হয় তা ইতালির নিয়ম মেনেই দেওয়া হয়। আমরা প্রশিক্ষিত কর্মী পাচ্ছি না। ইউরোপে শিপইয়ার্ডে কাজ করতে চায় এমন তরুণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্মহারের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি অন্যতম। ২০২৩ সালে দেশটিতে জন্ম নিয়েছে মাত্র তিন লাখ ৭৯ হাজার শিশু। দেশে শ্রমিকের সংখ্যাও কম। 

ধারণা করা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে ইতালিতে প্রতি বছর ২ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন হবে।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি কট্টর ডানপন্থি ব্রাদার্স অব ইতালির নেতা। 

এর আগে মেলোনি বলেছিলেন, তিনি অভিবাসন কমাতে চান। তা সত্ত্বেও অ-ইউরোপীয় কর্মীদের পারমিট বাড়ানো হয়েছে।

মেয়র মারিয়া বলছেন, বাংলাদেশের মুসলমানদের জীবনধারা আর ইতালিতে জন্মগ্রহণকারী মানুষের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন।  

মেয়র শহরের দুটি ইসলামিক সেন্টারে জামাতে নামাজ আদায় নিষিদ্ধ করার পর শহরে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। 

মারিয়া বলেন, শহরের লোকজন আমাকে অবাক করা ছবি, ভিডিও পাঠায়। এতে দেখা যায়, দুটি ইসলামিক সেন্টারে বিপুল সংখ্যক মানুষ নামাজ আদায় করছেন। এক বিল্ডিংয়ে ১৯০০ জন... ইসলামিক সেন্টার ধর্মীয় ইবাদতের জন্য নয়। নামাজের জায়গা দেওয়া আমার কাজ নয়।

মেয়র মারিয়া বলেন, ফুটপাতে অনেক সাইকেল চলে। এটা স্থানীয় মানুষের প্রতি অন্যায়।  

ইতালির আইনে ইসলামের কোনো আনুষ্ঠানিক মর্যাদা নেই। দেশটিতে মোট আটটি মসজিদ রয়েছে। সেখানে প্রায় ২০ লাখ মুসলমানের বসবাস। 

মনফ্যালকনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা বলছেন, মেয়রের এই সিদ্ধান্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।  

১৯ বছরের মেহেলি বলেন, মেয়র মনে করেন বাঙালিরা ইতালিকে ইসলামীকরণ করছে। কিন্তু আসলে আমরা শুধু নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। 
শিগগিরই ইতালি ছাড়বেন বলে জানিয়েছেন মেহেলি

মেহেলি ঢাকা থেকে এসেছেন এবং পশ্চিমা পোশাক পরেন। মেহেলি অনর্গল ইতালীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন।

তিনি বলছেন, শুধু বাঙালি পরিচয়ের কারণে মাঝখানে অনেকবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাব। 

এ বছরই ইতালির পাসপোর্ট পাওয়ার আশা করছেন মিয়া বাপ্পি। কিন্তু তিনি নিশ্চিত নন যে, এই শহরে আর থাকবেন কি না।

‘আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমরা ট্যাক্স দিই। কিন্তু এই মানুষগুলো চায় না আমরা এখানে থাকি।’ 

বাপ্পী আরও বলেন,আমরা সবাই যদি আমাদের দেশে ফিরে যায়, তাহলে জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি জাহাজ বানাতে পাঁচ বছর সময় নেবে। সম্প্রতি স্থানীয় একটি আদালত দুটি ইসলামিক কেন্দ্রের পক্ষে রায় দিয়েছে এবং একসঙ্গে নামাজ পড়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। 

তবে মেয়র মারিয়ার প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। তিনি একে ‘ইউরোপের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে প্রচারণা’ বলে অভিহিত করছেন।

মারিয়া এখন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। শিগগিরই তিনি সেখানেও আওয়াজ তুলবেন। 

বিবিসি।