শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে বাধ্য ভারত!
ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন ও গণবিপ্লবের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে পালানোর আগে ছাত্র ও জনতার গণঅভ্যুত্থানকে ঠেকাতে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। সীমাহীন সেই নৃশংসতায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন শত শত মানুষ, আহত হন হাজারো ছাত্র-জনতা।
শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি বেকায়দায় ফেলেছে নয়াদিল্লিকে। কারণ এখন তাকে ফেরত দিতে নয়াদিল্লির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি যে নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেছেন এ দেশের জনগণের ওপর, জাতি তার বিচার করতে চায়।
আমেরিকান অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনে নিয়ে এসেছে, শুধু তার জন্মভূমিতে নয়, সীমান্তের ওপারে ভারতেও। তার প্রত্যর্পণের জন্য ক্রমবর্ধমান দাবি ভারতকে কূটনৈতিক ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিতে পারে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে পরীক্ষায় ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে জনগণ শেখ হাসিনাকে প্রত্যাবাসনের আহ্বান জানিয়েছে, এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে: ভারত কি তার প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে? কীভাবে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি এই প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে?
ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিতে কী আছে?
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে প্রত্যর্পণ চুক্তি, তা ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ২০১৬ সালে সংশোধিত হয়েছিল। এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল যার লক্ষ্য ছিল দুই দেশের ভাগ করা সীমান্তে বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের সমস্যা মোকাবিলা করা। চুক্তির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পলাতক এবং অপরাধীদের প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়াকে প্রবাহিত করা, বিশেষ করে যারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত। ভারতীয় বিদ্রোহীদের বাংলাদেশে আশ্রয় খোঁজার বিষয়টি এবং ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশি জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের বিষয়টি মোকাবিলা করার জন্য মূলত এই চুক্তিটির সৃষ্টি।
এই চুক্তিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যেগুলোর জন্য উভয় দেশকে এমন ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণ করতে হবে যারা অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং তার জন্য সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি তার রয়েছে। দ্বৈত অপরাধের নীতি এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য প্রয়োজন যে অপরাধের জন্য প্রত্যর্পণের অনুরোধ করা হয়েছে তা অবশ্যই উভয় দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত। এই ধরনের অপরাধে সহযোগী হিসেবে সংঘটন, সহায়তা, প্ররোচনা, প্ররোচনা বা অংশগ্রহণের প্রচেষ্টাও চুক্তিটির আওতাভুক্ত।
ভারত কি শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে বাধ্য?
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারত আইনগত দিক থেকে বাধ্য। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে হওয়া প্রত্যর্পণ চুক্তিতে যেসব ধারা রয়েছে সেগুলো অনুযায়ী, শেখ হাসিনাকে ভারতের ফেরত দিতে হবে। তবে তারা চাইলে চুক্তির কিছু ধারা দেখিয়ে তাকে প্রত্যর্পণে অস্বীকৃতিও জানাতে পারে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত হত্যা, নির্যাতন, গুম, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শতাধিক মামলা হয়েছে। আর এসব অভিযোগ ওঠায় তাকে ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়াও কঠিন হতে পারে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলেছে, ভারত কয়েকটি কারণ দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত নাও দিতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
শেখ হাসিনা বর্তমানে যেসব গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হচ্ছেন, তাতে করে বাংলাদেশে তার ভবিষ্যত অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তার রাজনৈতিক মর্যাদা এবং অভিযোগের প্রকৃতি বিবেচনা করে ভারতে আশ্রয় চাওয়া তার জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তা সত্ত্বেও, প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া ২০১৬ সংশোধনীর কারণে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে।
এর মধ্যে আবার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারাও রয়েছে। ৬ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো দেশ মনে করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা করা হয়েছে তাহলে তাকে প্রত্যর্পণে অস্বীকৃতি জানানো যাবে। কিন্তু এই ধারাতেই আবার বিশেষভাবে উল্লেখ আছে— হত্যা, সন্ত্রাসবাদ ও অপহরণের মতো অপরাধগুলো রাজনৈতিক অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। আর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব মামলা করা হয়েছে সেগুলোর সবই হত্যা, অপহরণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা হয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট জানিয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে ধারা ৬ অনুযায়ী ভারত তাকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে না।
আরেকটি হলো ধারা ৮। এতে বলা আছে, যদি ‘অসৎ নিয়তে’ কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয় তাহলে তাকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানানো যাবে। ভারত এই ধারাটি ব্যবহার করতে পারে। তারা দাবি করতে পারে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সঠিক বিচার করার ‘সৎ নিয়তে’ মামলা করা হয়নি।
বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে, যদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ করে, তাহলে এটা স্পষ্ট যে ভারত প্রত্যর্পণের বৈধ কারণ না থাকলে চুক্তির মাধ্যমে প্রত্যর্পণ করতে আইনত বাধ্য।
বাংলাদেশ-ভারত কূনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব
যাইহোক, ‘হস্তান্তর প্রত্যাখ্যান’ করা নয়াদিল্লি এবং ঢাকার নতুন শাসক ব্যবস্থার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ককে টেনে আনতে পারে। অন্যদিকে, হাসিনাকে প্রত্যর্পণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের জন্যও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যদি ভারত তাদের দীর্ঘদিনের মিত্রকে পরিত্যাগ করতে রাজি না হয়।
ভারত যদি শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করাতে প্রত্যাখ্যান করে তবে অন্তর্বর্তী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের স্খলন ঘটতে পারে। যার ফলে বর্তমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিপণ্ন হতে পারে। বিপরীতে, প্রত্যর্পণের অনুরোধে সম্মত হওয়া বাংলাদেশ এবং ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। কারণ ভারত হাসিনাকে দীর্ঘদিনের মিত্র এবং কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে।
আমেরিকান গণমাধ্যমটি মনে করছে, ভারতকে অবশ্যই প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে জনগণের অনুভূতি, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং আইনি বাধ্যবাধকতার জটিল বিষয়গুলো খুব সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করতে হবে। যদিও চুক্তির ভাষায় প্রত্যর্পণ এবং প্রত্যাখ্যানের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে, তারপরও যে কোনো সিদ্ধান্তের বিস্তৃত প্রভাব সম্ভবত আইনি কাঠামোর বাইরে প্রসারিত হবে। শেষ পর্যন্ত, ভারত প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত নেয় নাকি প্রত্যাখ্যান করে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সীমান্তের উভয় দিকে জনসাধারণ ও রাজনৈতিক প্রভাবগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে তার ওপর নির্ভর করবে।