মাফিয়া সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আসাদুজ্জামান নূর

আসাদুজ্জামান নূর। ফাইল ছবি

অভিনেতা হিসেবে আসাদুজ্জামান নূর বেশ সমাদৃত। বিশেষ করে ‘কোথাও কেউ নেই’ নামক টেলিভিশন ধারাবাহিকে বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের হৃদয় জয় করেন তিনি। তবে পর্দার বাকের ভাইয়ের বাস্তবে আরেক চরিত্র আছে, যা অনেকেরই অজানা। আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাংসদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের হুকুম দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ। সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপনের বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও রয়েছে।

গতকাল সোমবার আসাদুজ্জামান নূরকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। হোটেলকর্মী হত্যা মামলায় মাথা নিচু করে আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাংসদ ও সংস্কৃতিমন্ত্রী এজলাসে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রায় এক ঘণ্টা।

দুর্দান্ত অভিনেতা এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকায় বেশ দাপুটে ছিলেন আসাদুজ্জামান। নীলফামারীর ছেলে আসাদুজ্জামান নূর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পরে পুরো মনোযোগ দেন নাট্য আন্দোলনে। 

২০০১ সালে নীলফামারী-২ আসন থেকে প্রথমবারের মতো নৌকা প্রতীকে  সংসদ সদস্য হন। এরপর আরও চারটি নির্বাচনে জয়ী হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে জেতার পর সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাকের ভাই নামে পরিচিত আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে শুধু যে ক্রসফায়ারের অভিযোগ রয়েছে তা নয়, প্রভাব খাটিয়ে নিজ বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের বাজার কুক্ষিগতও করেছিলেন তিনি।

২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর নীলফামারীতে আসাদ্দুজামান নূরের গাড়িবহরে পরিকল্পিত হামলার নাটক সাজানো হয়। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ আমলে নীলফামারীর ছয়জন ব্যক্তিকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশে। মূলত, গাড়িবহরে হামলার নাটক সাজিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে তাদের গুম ও খুন করা হয় নূরের নির্দেশে।

সেসব ক্রসফায়ারে নিহতদের একজন বিএনপি নেতা গোলাম রব্বানী। তিন সন্তানের জনক ছিলেন রব্বানী। তার স্ত্রী শাহনাজ মায়ের ডাক নামে একটি সংগঠন আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বলেছেন, তার স্বামীর ক্রসফায়ারের পেছনে ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর।

শাহনাজের অভিযোগ, নূরের গাড়িবহরে হামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন  বিএনপি নেতাকর্মীকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের (ক্রসফায়ার) মাধ্যমে হত্যা করা হয়। এছাড়া আরেকজন শিবিরকর্মী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। আরও এক জামায়াত নেতাকে কথিত মটরসাইকেল চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ, সহজেই তাদের গ্রেপ্তার করা যেত।

এলাকাবাসী বলছেন, নূরের নির্দেশে হত্যার পর তাদের লাশ রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হয়। পরিবারের লোকজন মরদেহ নিয়ে এসে দাফনের প্রস্তুতি নিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেন।

হত্যার ১১ বছর পর মামলা

গত ১৫ সেপ্টেম্বর নীলফামারীতে বিএনপি নেতা গোলাম রব্বানীর হত্যার অভিযোগে ১১ বছর পর আওয়ামী লীগের ৪১ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে আরও ১ হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়৷

গত রোববার নীলফামারী সদর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিহতের স্ত্রী শাহনাজ বেগম বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। আসামিরা হলেন- নীলফামারী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল হক প্রমুখ।
 
বিজ্ঞাপনের বাজারে মাফিয়া চক্র

অভিনেতা হিসেবে আসাদুজ্জামান নূর দর্শকনন্দিত হলেও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিন্দিত। তার প্রভাব খাটিয়ে আটটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এশিয়াটিক, এশিয়াটিক মাইন্ড শেয়ার, মিডিয়া কনসালন্টেট, এমইসি, এমবিএ, ওয়েবমেকার, এশিয়াটিক এমসিএল, এম পাওয়ার এবং নেক্সাস। এছাড়াও তাদের মালিকানায় রয়েছে ফোরথট পিআর, এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটি। 

বিজ্ঞাপনী বাজারের আসাদুজ্জামানের মাফিয়া চক্রের অন্যতম সহযোগী আলী যাকের। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী সারা যাকের ও ছেলে ইরেশ যাকের এবং মোশেদুল ইসলাম ও আসাদ্দুজামান নূর মিলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করেন।

বিদেশি ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার পেছনেও রয়েছে এই চারজনের হাজার হাজার কোটি টাকার লগ্নি। এসবের জন্য প্রধান প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে গ্রুপ এম। এই প্রতিষ্ঠানটি আসাদুজ্জামান নূরের। যদিও নূর সরাসরি এটি পরিচালনা করেন না। প্রতিষ্ঠানটির হয়ে কাজ করেন এমডি মোশেদুল ইসলাম। বাংলাদেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রের সব ধরনের বিজ্ঞাপনও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

আরও পড়ুন: বিজ্ঞাপনের বাজার ছিল এশিয়াটিকে জিম্মি, ভোল পাল্টাচ্ছেন কর্তারা

বাংলাদেশে বর্তমানে একটি সরকারি ও ৩৭টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলসহ মোট ৩৮টি টিভি চ্যানেল আছে। একটি সরকারি রেডিও এবং ১৪টি বেসরকারি রেডিও আছে। এছাড়া দৈনিক পত্রিকা আছে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ৭০টি। এদের সবার বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করে মিডিয়া মাফিয়া বলে পরিচিত গ্রুপ এম। এজন্য এই মাফিয়া গ্রুপটি মিডিয়ার ওপরেও খবরদারি করতে শুরু করে। তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে অনেক দামে টিভি চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপন প্রচারে বাধ্য করে। এছাড়া বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধে গড়িমসি করে থাকে তারা। ভ্যাট ফাঁকি, বিজ্ঞাপন প্রচারের পর কর্তনসহ সব ধরনের অপকৌশল প্রয়োগ করেছে চক্রটি। বিনা পয়সায় বিজ্ঞাপন ছাপতেও বাধ্য করে এই মাফিয়া চক্রটি। যদিও সার্ভিস চাজ হিসেবে তারা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকে। আগে বাংলাদেশের প্রথম সারির টিভি চ্যানেলগুলোর মাসিক আয় ছিল ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। এই মাফিয়া চক্রের কারণে সেই আয় চার থেকে পাঁচ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। প্রথম দিকে প্রতি মিনিট বিজ্ঞাপন মূল্য ছিল ৬০,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা; যা ১০ থেকে ১৫ হাজারে নেমে এসেছে। এই মাফিয়া গ্রুপের বিজ্ঞাপনের বাজারে একনায়কত্ব কায়েম করার জন্য অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানে থাকলেও শুধুমাত্র অস্তিস্ব বাঁচানোর জন্য চালু রেখেছে। বাদ যায়নি আওয়ামী সমর্থকরাও। যাদের মধ্যে রয়েছেন রামেন্দ্র মজুমদারের এক্সপ্রেশন লিমিটেড এবং শমী কায়সারের ধানসিঁড়ি।

সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইন্টার স্পিড বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া মিডিয়া ক , ইউনিট্রেন্ড লিমিটেড, এফসিপি/বিটপি কোনমতে টিকে আছে। গ্রে ঢাকা সব ক্লাইন্ট নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। গত চার বছর ধরে টপ অব মাইন্ডের মতো বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থার কোন কাজ নেই। দেশী বা বিদেশি কোন বিজ্ঞাপনী সংস্থা আর দাঁড়াতে পারছে না।

একই চিত্র রেডিও বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও। নূর মাফিয়া চক্রের মালিকানায় রয়েছে রেডিও স্বাধীন। ভালো কিছু করতে না পারলেও এই রেডিও’র বিজ্ঞাপনের দর সবচেয়ে বেশি। তাদের রেডিও বিজ্ঞাপনের দর পাঁচ থেকে ৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে সব রেডিও বিজ্ঞাপনের দর ২০০ টাকা থেকে  ১০০০ টাকা। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার কারণে দুইটি রেডিও স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপনী আইন অনুযায়ী, একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা একই ধরনের প্রতিযোগী একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন করতে পারবে না। তবে সেটি হরহামেশাই করে গেছে এশিয়াটিক ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো। এই চক্রটি প্রতিযোগী পেপসি ও কোকাকলা, হোন্ডা ও বাজাজের বিজ্ঞাপন করেছে। রবি, এয়ার টেল বা গ্রামীণফোনের মতো প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই গ্রুপ এম একচেটিয়া ব্যবসার মাধ্যমে এই খাতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

এছাড়া, মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে আসাদুজ্জামান নূর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিজের মালিকানায় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: বিজ্ঞাপনের বাজার ছিল এশিয়াটিকে জিম্মি, ভোল পাল্টাচ্ছেন কর্তারা