হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফর মানেই ছিল দলবেঁধে প্রমোদ ভ্রমণ
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন মানেই ছিল বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের কাছে উৎসব। অধিবেশনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার বহু আগে থেকেই সাজসাজ রব উঠে যেত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে মিডিয়া পাড়ায়। বাদ যেত না দেশের বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিক নেতা কিংবা ব্যবসায়ীরা। অতীতে কয়েকশ সফরসঙ্গী নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এভাবেই প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। কিন্তু সময় পাল্টেছে। ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এই সংস্কৃতিতেও আসছে আমূল পরিবর্তন। এবছর মাত্র ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিষয়টি ইতিমধ্যেই বেশ ইতিবাচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সফর করবেন তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই হবে তার প্রথম বিদেশ সফর।
ড. ইউনূসের সফরসঙ্গীদের মধ্যে আছেন- মেয়ে দিনা আফরোজ ইউনূস, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আলম।
বাকি তিন সফরসঙ্গী হচ্ছেন- প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব শাব্বীর আহমদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দলগুলোর মধ্যে এবারই সবচেয়ে ছোট দলগুলোর একটি নিয়ে সফর করবেন ড. ইউনূস।
এর আগে, ২০১৫ সালে শেখ হাসিনা ২২৭ জনের একটি দল নিয়ে নিউইয়র্কে ৭০তম সাধারণ অধিবেশন এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যান। তারও আগে ২০১৪ সালে ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে তার সঙ্গীর সংখ্যা ছিল ১৭৮, আর ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৩৪ জন।
কেবল জাতিসংঘ অধিবেশনই নয়, শেখ হাসিনার বিদেশ সফর মানেই যেন ছিল প্রমোদ ভ্রমণ। নিজ পরিবারের সদস্য ছাড়াও তিনি নিয়ে যেতেন দলীয় নেতাকর্মীদের। যেতেন তার আশির্বাদপুষ্ট অনেক মিডিয়া কর্মীও। সর্বশেষ দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় গত ৭ জুলাই ১৯৬ জনের বিশাল বহর নিয়ে চীন সফরে যান শেখ হাসিনা। ওই সফরে বাংলাদেশের তেমন কোনো অর্জন না থাকলেও বিশাল এই সঙ্গীদলের যাবতীয় খরচ বহন করা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে।
তার চীনে অবস্থানকালীনই দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করে। পরে সফর শেষ না করেই তিনি একদিন আগে ১০ জুলাই রাতেই দেশে ফেরেন। আর পরদিন সকালেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর প্রথম হামলা করে পুলিশ বাহিনী।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে শেখ হাসিনার প্রতিনিধি দলে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা থাকতেন। তবে ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টাকে রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সফরে প্রধান উপদেষ্টা প্রতিনিধি দলকে কার্যকর ও যতটা সম্ভব ছোট রাখতে চান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অতীতে জাতিসংঘ সফরে পররাষ্ট্র দপ্তরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিপুল সংখ্যক ডেলিগেট অংশ নিতেন। সেক্ষেত্রে এবার তার পুরো ব্যতিক্রম।
এতে অধিবেশনের কোনো বৈঠকে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি-না এমন প্রশ্নে মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, জাতিসংঘ অধিবেশনের মূল অধিবেশন ও সাইড লাইনের বৈঠকেও যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই ডেলিগেট ঠিক করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব, অধিবেশন উদযাপন নয়।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশন আগামী ১০ সেপ্টেম্বর শুরু হবে। উচ্চপর্যায়ের সাধারণ আলোচনা শুরু হবে ২৪ সেপ্টেম্বর। আর সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে বৈশ্বিক সুশাসনে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে আগামী ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ‘সামিট অব দ্য ফিউচার’-এ যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে শীর্ষ নেতাদের।