জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের পাশে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন

ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

ঘটনাটি ৪ আগস্টের। সেদিন সকালে মফস্বল শহর ফেনীর বড় রাস্তায় ছাত্র-জনতার মিছিলে যুক্ত হন হোটেল বয় ফয়েজ আহমেদ পারভেজ (২০)। মিছিলের সঙ্গে কিছুদূর হেঁটে যেতেই তার মনে হলো গুলির শব্দে কী যেন একটা দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো। মিছিলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দিক থেকে আসা ছররা গুলি এসে লাগে পারভেজের বাম পায়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে পড়ে যায় রাস্তায়।

প্রথম ফেনীর একটা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন পারভেজ। পায়ে বিদ্ধ হওয়া ছররা গুলিগুলো সরিয়ে ফেলেছিল চিকিৎসক। তিনি পারভেজের পা প্লাস্টার করে দেন। তখন তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। চিকিৎসক বলেছিলেন- পায়ের ক্ষত শুকাতে গেলে আরও বেশি দিন হাসপাতলে থাকতে হবে।  

পরদিন ৫ আগস্ট হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবারও মিছিলে যান পারভেজ। সকাল ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে ছিলেন। ট্রাংক রোডের দোয়েল চত্ত্বরে আবার ছররা গুলি এসে লাগে তার গায়ে। এবার বা চোখেও গুলি লাগে।  রাস্তায় পড়ে যান পারভেজ। তখন তার চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। দুই চোখে সে কিছুই দেখছিল না। তাকে কয়েকজন এসে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হাসপাতাল ঘেরাও করে রেখেছিল। তবুও চেষ্টা করে এক হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে, কিন্তু সেখানে চিকিৎসক ছিল না। পরে সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পারভেজ চিকিৎসকদের বলেন, তাকে জরুরি চিকিৎসার জন্য। তবে তারা পারভেজের চোখে কোন গুলি নেই বলে জানান। তারপরও ফেনী শহরের সরকারি হাসপাতালে আট দিন ভর্তি থেকেও কোন চিকিৎসা পাননি বলে জানান পারভেজ। তিনি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের জন্য যাননি, কারণ সেখানে বেশ অঙ্কের টাকা লাগবে।

তবে পারভেজের চিকিৎসার সহায়তায় এগিয়ে এসেছে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন। ফেনীর বাসিন্দা বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মশিউর রহমান বিপ্লব পারভেজকে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের দুই আজীবন সদস্য প্রফেসর ডা. মেহবুব উল কাদির এবং ড. হাসানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারাই ফাউন্ডেশন থেকে পারভেজের চোখের চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচারের জন্য ঢাকায় আসতে বলে। যদিও তার চিকিৎসা হয়েছে শেষ পর্যন্ত সরকারি খরচেই।

ফেনী শহরের এই রেস্টুরেন্ট বয় পারভেজ কথা বলেছেন দ্য মিরর এশিয়ার মঞ্জুর মোর্সেদ রিকির সঙ্গে। সেই আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার মিছিলে যাওয়া, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হওয়া ও তার পরবর্তী গল্প। এর মাঝে বলে রাখা ভালো, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফেনীর মহীপালে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ প্রায় ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল।

জানতে চাইলে ফয়েজ আহমেদ পারভেজ বলেন, এখন দেখছি কোন দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ব্যথা করে। ঘুমানোর সময় যন্ত্রণা করে। চোখের মণি ঘোরালেই ব্যথা করে। দেখতে একটু অসুবিধা হয়। পায়ে ছররা গুলি লাগায় হোটেল ডিউটি করতেও বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। দুই মাস হয়ে গেল কোন চিকিৎসাই হচ্ছিল না, বা চোখটা বোধহয় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে।

আন্দোলনের সময়কার কথা জানতে চাইলে স্মৃতিচারণ করে পারভেজ জানান, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের হাতে প্রথমে কোন বড় অস্ত্র ছিল না। তবে কয়েকজনের হাতে লাঠি, পিস্তল এবং বড় বড় ছুরি ছিল। পরে একটা গাড়ি করে টাংগুয়া রোডে এসব অস্ত্র নিয়ে আসে আওয়ামী লীগ। প্রত্যেকটি নেতাকর্মীর হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়া হয়। এই সময় কোন পুলিশ ছিল না।

তিনি বলেন, যেহেতু আমি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি খেয়েছি। এই আন্দোলনে ছাত্র ভাইয়েরা আহত হয়েছে এবং নিহত হয়েছে। কেউ পঙ্গু হয়েছে। আমার গর্ব ভাইদের সঙ্গে একসাথে থেকে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে ভালো লাগছে। ভবিষ্যতেও দেশের মানুষের পাশে থাকতে চাই।

নিজের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি জানি, আমার চোখের অপারেশনের ব্যবস্থা করছে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন। আমি জানি এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

পারভেজের চিকিৎসা প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের আজীবন সদস্য প্রফেসর ডা. মেহবুব উল কাদির বলেন, বলেন, পারভেজের চোখে ছররা গুলি বড় ধরনের ক্ষতি করেনি। তবে বেশি দিন এ অবস্থায় থাকলে চোখে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় অপারেশন করা হয়েছে। তিন মাসেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রায় ৭০০ ছাত্র-জনতা চোখে গুলি খেয়েছে। আমরা অনেক শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ রোগী হিসেবে পেয়েছি, তারা চোখ হারিয়েছে। বিশেষ করে সরকারি বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের গুণ্ডা বাহিনীর গুলিতে যুবকরা দুই চোখই হারিয়েছে। এই যুবকের সংখ্যা বেশি।

ডা. এম. আর. হাসান বলেন, জুলাই আর আগস্ট মাসে কোটাবিরোধী আন্দোলনে পুলিশ আর আওয়ামী লীগের গুলিতে আহত যারাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন সবাইকে আমরা ফাউন্ডেশন পক্ষ থেকে তাদের সর্বাত্মক সাহায্যে এগিয়ে এসেছি। পারভেজ ফেনী শহর থেকে এসেছে কোনভাবেই তিনি আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তাকে বেসরকারি বাংলাদেশ আই হাসপাতালে চোখ অপরেশন করানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুসারে সরকারি ব্যয়ে বেসরকারি আই হাসপাতাল তার অপারেশনটা করা হয়েছে। এ অপারেশনের ব্যয় ৬০ হাজার টাকা বহন করবে সরকার। সরকার এই সহায়তা না করলে আমাদের জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন এই ব্যয় বহন করতো। জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন ২০১৬ সাল থেকে স্বৈরশাসক পুলিশ এবং আওয়ামী লীগারদের গুলি এবং নির্যাতনে আহত বিএনপিসহ সকল বিরোধী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপারেশন খুব কষ্টে পুলিশ গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্বৈরাচার আওয়ামী সরকাররের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় এ কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। একজন আহত রোগীর চোখে দুই থেকে তিন বার অপারেশন করতে হয়েছে। সব খরচ ফাউন্ডেশন বহন করেছে। দীঘ ১৬ বছর স্বৈরশাসক থাকার কারণে এ প্রতিষ্ঠানের কার্ষক্রমের কোন কিছুই তেমনভাবে মিডিয়াতে আসেনি।