মন্ত্রীর ছোঁয়ায় হাজার কোটির মালিক এপিএস
রিদুওয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম। যুক্তরাজ্যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৩৬০টি বাড়ি কিনে তুমুল সমালোচিত সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের এপিএস (একান্ত ব্যক্তিগত সচিব)। জাবেদের পর এখন আলোচনায় রয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, জাবেদের সঙ্গে থেকে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন সায়েম। টেন্ডার বাণিজ্য, দলীয় পদ বিক্রি, মনোনয়ন বাণিজ্য, ঠিকাদারি, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানাভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি।
নামে-বেনামে সায়েমের রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট, শপিংমলে শোরুম, কয়েক হাজার শতক জমি। থাকেন রাজধানীর বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। রয়েছে ব্যক্তিগত দুই গাড়ি। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এসব গড়েছেন সায়েম- জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ছিলেন তার এপিএস সায়েম। এমনকি দলীয় পোস্টারেও জাতীয় নেতাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হতো সায়েমের ছবি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হতেন প্রধান অতিথি। সায়েমের কথার বাইরে গেলে পদপদবি হারাতে হতো দলের নেতাদের- রয়েছে এমন অভিযোগও।
সায়েমের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর ইউনিয়নে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তিনি। দেড় দশক আগেও সাধারণ জীবনযাপন ছিল সায়েমের পরিবারের। জাবেদের এপিএস হওয়ার পর থেকে বদলে গেছে সেই চিত্র। এখন দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদের মালিক সায়েম।
সরকার পতনের পর সায়েম থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এসব বিষয়ে কথা বলতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
নামে-বেনামে জমি
২০২২ সালে সায়েমসহ তিনজন মিলে ২৮০ শতক জমি কেনেন পটিয়ায়। যেটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করেন তারা। জমি কেনা অন্য দুজন হলেন- দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রঘুপতি সেন।
এছাড়া কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী এবং আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে মিলে আনোয়ারায় সিইউএফএল সার কারখানার পাশে ৮০ শতক জমি কেনেন সায়েম। যেটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় আট কোটি টাকা।
এসবের বাইরে আনোয়ারা মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে ৮০ শতক, ফকিরনিরহাট এলাকায় গরুর বাজারের পাশে ৪০ শতক এবং আনোয়ারা বৈরাগ পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে প্রায় ৮০ শতক জমি রয়েছে সায়েমের। বছর দেড়েক আগে পটিয়ার কাশিয়াইশ ইউনিয়নের নয়াহাট এলাকায় কিনেছেন আরো ৩৬০ শতক জমি। শ্বশুরবাড়ি রাউজানেও সায়েম নামে-বেনামে অনেক জমি কিনেছেন বলে জানা গেছে।
বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, শপিংমলে শোরুম
চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেট এলাকার মিমি সুপার মার্কেটে রয়েছে সায়েমের বিশাল শোরুম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বিপরীতে একটি গলিতে রয়েছে বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাট। একটি ফ্ল্যাট চার বছর আগে কেনা হয়। অপরটি কেনেন বছরখানেক আগে।
এর বাইরে সায়েমের রয়েছে ব্যক্তিগত দুটি গাড়ি। ঢাকায় গেলে তেঁজগাও এলাকায় একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি।
হাসপাতালের মালিকানা, গ্যাসের ডিলারশিপ
নগরের জিইসি মোড়ের এশিয়ান হাসপাতাল, গোল পাহাড় মোড়ের চট্টগ্রাম হেলথ পয়েন্ট, সার্সন রোডের নিউ হ্যাপি লাইফ হাসপাতালে সায়েমের রয়েছে নামে-বেনামে শেয়ার। ১০ কোটি টাকা সিকিউরিটি মানির বিপরীতে ইউনি গ্যাসের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ডিলারশিপও কেনেন তিনি। এছাড়া বেসরকারি ইউসিবি ব্যাংকে কর্মরত ভাই মঈনুল করিমের নামে করেছেন সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স।
দলের ভেতর বাণিজ্য, প্রকল্পের কমিশন
সায়েমের কনস্ট্রাকশন ব্যবসা দেখাশোনা করেন উপজেলার আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক জসিম উদ্দিন। তার হয়ে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা দেখেন হাইলধর এলাকার মোহাম্মদ আনিস।
স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন এপিএস সায়েম। আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার দলীয় পদপদবি ও নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে- সায়েমের মতের বাইরে গেলে বাদ দেওয়া হতো দলীয় পদপদবি থেকে। এজন্য তাকে খুশি রাখতে ব্যানারে তার ছবি ব্যবহার করতেন দলীয় নেতারা। অনোয়ারা-কর্ণফুলীর অবৈধ তেল চোরাকারবারি ও মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন সায়েম। টিআর-কাবিখা প্রকল্পের বরাদ্দ থেকেও নিতেন কমিশন।
ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ
২০১৭ সাল থেকে আনোয়ারার বেসরকারি রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কোরিয়ান ইপিজেডে ‘ইয়াংওয়ান’ কারখানায় বছরে ৩০০ কোটি টাকার কনস্ট্রাকশন ও বিভিন্ন পণ্য সাপ্লাইয়ের কাজ করে আসছে নাজ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক জসিম উদ্দিন। কিন্তু কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রীর এপিএস সায়েম।
২০১১ সাল থেকে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) সার কারখানায় কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই সার লোড-আনলোডের কাজ করে আসছে আরএ এন্টারপ্রাইজ। যেটির মালিক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। সায়েমের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বছরে পাঁচ কোটি টাকার লোড-আনলোড কাজ করতেন তিনি।
কাফকোতে তিন কোটি টাকার ক্যাজুয়াল শ্রমিক সাপ্লাইয়ের কাজও করতো আলাউদ্দিনের আরএ এন্টারপ্রাইজ। এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে বছরে তিন কোটি টাকার ক্যাজুয়াল শ্রমিক সাপ্লাই ও এক কোটি টাকার সার উৎপাদন কাজও ছিল তাদের দখলে। মূলত সায়েমই কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানান এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিলে কারখানার কার্যক্রমে বাধা তৈরি করতেন সায়েম। এছাড়া ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডে কনস্ট্রাকশন ও পণ্য সাপ্লাই কাজ হাতিয়ে নেয় তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কেএম কর্পোরেশন এবং আজওয়াদ এন্টারপ্রাইজ। পরে ১৫ শতাংশ লাভে এসব সাব-ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেন তিনি।
অতিষ্ঠ স্থানীয়রা, ভয়ে মুখ খোলেননি দলের নেতাকর্মী
স্থানীয়দের মতে, গত ১০ বছরে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন এপিএস সায়েম। অবৈধ ব্যবসা, টেন্ডার বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে হাতিয়ে নেন হাজার কোটি টাকা।
স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা বলেন, সায়েমের কাছে অসহায় ছিলেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তার দাপটে মুখ খুলতে পারতেন না কেউ। এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ধ্বংস করে সরকার পতনের পর তিনি থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছেন। আমরা তার বিচার চাই।