যেমন গেল অন্তর্বর্তী সরকারের ২ মাস
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতত্বাধীন সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়ে ৮ আগস্ট গঠিত হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথচলার দু’মাস হলো আজ মঙ্গলবার। অভ্যুত্থান উত্তর অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণ করে দেশকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় নিতে দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছেন তারা। এ স্বল্প সময়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চলমান করার পাশাপাশি দৃষ্টি দিয়েছেন রাষ্ট্র সংস্কার, মানবাধিকার, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে। অন্তর্বর্তী সরকারের এসব উদ্যোগ ব্যহত করতে প্রথম থেকে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। তবে সব উপেক্ষা করেই এগিয়ে চলছে অন্তর্বর্তী সরকার। গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে চায় এ সরকার। সেই লক্ষ্যে তৃতীয়বারের মতো সংলাপ করছে গণহত্যায় অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের সাথে।
গত ৫ আগস্ট হাজারো শহীদের রক্তে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সাড়ে ১৫ বছরের সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন দুপুরে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। এর পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
মানবাধিকার : চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে দ্রুত কাজ চলছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে। এর আগে মানবাধিকারের বিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখভালের জন্য সরকারের গঠিত ‘জুলাই ফাউন্ডেশন’র কাজ শুরু হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির সবাইকে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ক্ষমা করে দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অনুরোধে। এ ক্ষমা পাওয়া অনেকে ইতিমধ্যে দেশেও ফিরে এসেছেন।
সংসদ, আদালত, ইসি : ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেন। ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। একই দিনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তার আগে ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামানকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করে। কাজ শুরু হয়েছে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনেরও।
রাজনীতি : ৬ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল ও জোট পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে না। গণহত্যা অভিযুক্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
আর্থিক খাত ও দুর্নীতি দমন : ১০ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে নয়টির মালিকানা ছিল এস আলম গ্রুপের। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী, পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
শেয়ারবাজারে বেক্সিমকো, লা-মেরিডিয়ান হোটেলসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অর্থপাচারে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সিআইডি। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালীদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর কাজও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগ দেয়া নতুন গভর্নর লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোকে আবারো নিয়মের ভেতর আনার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া সাত বড় কোম্পানির সম্পদ হস্তান্তর বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে জাতিয় রাজস্ব বোর্ড।
প্রশাসন স্থানীয় সরকার : ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে চেয়ারম্যানদের অপসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিষয়টি পরবর্তী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপিত হবে। এর আগে ১৯ আগস্ট সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ ও প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ১২ আগস্ট বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। পরে তা কার্যকর করা হয়। আবার প্রশাসনে নতুন করে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগও দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পদে পরিবর্তন এসেছে। উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। প্রায় অর্ধশত জেলায় ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সম্পদের হিসাব : সরকারি সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি : বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ হবে গণশুনানির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশে নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন হয়েছে। বিদ্যুাৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর আওতায় নতুন কোনো চুক্তি হবে না।
স্বাস্থ্য: আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারকে সহায়তা দিতে কমিটি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসা সেবার গুণগত মানোন্নয়ন, কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ
কমিটি গঠন করে ৩ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
শিক্ষা : শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষাক্রম নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে মাধ্যমিকে আবারও ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা। তবে উচ্চ শিক্ষায় স্থবিরতা কাটেনি। ইউজিসি চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনেস্থা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
পরিবেশ: রামুর সংরক্ষিত বনে বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ বাতিল করা হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ৬৪ জেলায় অন্তত ৬৪টি নদী চিহ্নিত করে নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সিদ্ধান্ত : ৫ সেপ্টেম্বর গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভু ̈ত্থান জাতীয় জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২৯ আগস্ট ‘জাতির পিতার পরিবার- সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ -এর খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তাসুবিধা পাবেন না। ১৩ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই দিনে সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে সচিবদের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গণপিটুনি: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই দুই মাসে সারা দেশে কমপক্ষে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইনজীবী ও রাজনীতিবিদেরা বলেছেন, বিচারিক প্রক্রিয়ার ছাড়া যে কোনো হত্যাই বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং এ সবের দায় সরকারকে নিতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দেধর (আসক) তথ্যা অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৪৯ জনের। তবে মাত্র তিনটি ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি, তারা বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
সরকার বলছে, জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর চলতি বছরের এই ৯ মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৮১ জনকে গণপিটুনিতে বা পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টে ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে, আর ২৮ জনকে সেপ্টেম্বরে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই দুই মাসে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগের সাত মাসে এমন ঘটনা অনেক কম।