পর্যটকে মুখরিত হাওর, দুই মাসের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আশায় ব্যবসায়ীরা
তিন দফা বন্যা ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে প্রায় দুই মাসের মতো বন্ধ ছিল সুনামগঞ্জের হাওরের পর্যটন ব্যবসা। বড় রকমের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল পর্যটন ব্যবসায়ীদের। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকায় পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ তাহিরপুর সীমান্তের কাছে পর্যটন এলাকাগুলোতে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি পর্যটন এলাকায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিখ্যাত জলরাশির হাওরের দিকে ছুটছেন অনেকে। পর্যটকদের আগম বাড়তে থাকায় দুই মাসের ক্ষতি কাটিয়ে নতুন করে শুরুর সাহস পেয়েছেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
হাওরের বুকে ঘুরে বেড়ানো হাউজবোটগুলোর মালিকরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গেল ২ মাস পর্যটক আসেনি হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে। এ কারণে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে এখন পর্যটকের উপচে পড়া চাপে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। ২ মাসের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ভরসা পাচ্ছেন তারা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দীর্ঘ সময় দেশের ভ্রমণপ্রেমী মানুষদের পর্যটন এলাকাগুলোতে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি। অন্যদিকে গেল ৮ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৩ দিন বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করেছে প্রশাসন। এতে ভ্রমণপ্রিয় মানুষরা হাওরকেই বেছে নিচ্ছেন।
হাউজবোট মালিকরা জানান, গত কয়েকদিন ধরেই হাউজবোটগুলো অগ্রিম বুকড হয়ে গেছে। শিডিউল মেনে ট্যুর পরিচালনা করতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহীদ সিরাজ লেক (নীলাদ্রি লেক), শিমুল বাগান, টাঙ্গুয়ার হাওর, জাদুকাটা নদীসহ অন্যান্য পর্যটন স্থানগুলো লোকে লোকারণ্য।
রাজশাহী থেকে প্রথমবারের মতো তাহিরপুরের পর্যটন এলাকায় ঘুরতে এসেছেন ব্যাংকার আজিজ সরকার। তাদের দলে মোট ৩৬ জন পর্যটক রয়েছেন। এরমধ্যে ২৫ জন উত্তরা ব্যাংক ও ৯ জন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে কাজ করেন। তাদের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপকও রয়েছেন। আজিজ সরকার বললেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর আমাদের দারুণভাবে পুলকিত করেছে। আমরা মহা আনন্দিত। এত বড় হাওর এর আগে আমরা দেখিনি। হাওরের বৈচিত্র্য, বিশেষ করে এর পাড়ে পাড়ে কিছু বসতি রয়েছে। তারা কিভাবে টিকে রয়েছে, জীবনযাপন করছে, এটি আমাদের মনে দাগ কেটেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নীলাদ্রি লেকের (শহীদ সিরাজ লেক) পাড় দিয়ে আমরা হেঁটেছি। অনেক সুন্দর একটি লেক। আমরা ছাড়াও আরও শতশত পর্যটক এসেছেন।’
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মাহবুবা রহমান সাথী বলেন, ‘অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা ছিল টাঙ্গুয়ার হাওরে আসার। এখন আবহাওয়াও ভালো তাই চলে এলাম। পরিবারের সবাই মিলে ১২ জনের একটি গ্রুপ এলাম। সিলেট সবসময়ই সুন্দর। হাওর আরও বেশি সুন্দর। সকাল থেকে হাউজবোটে ঘুরেছি। খুব ভালো লাগছে।’
নয়নাভিরাম প্রকৃতিতে প্রশান্তি মিললেও সড়ক যোগাযোগে রয়েছে ভোগান্তি। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে একাধিক জায়গায় ভাঙাচোরা সড়ক রয়েছে। কোথাও সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। এই সড়কের শক্তিয়ারখলা এলাকায় সংস্কার কাজের জন্য প্রায়ই যানবাহনের ধীরগতি দেখা যায়। ট্যাকেরঘাট থেকে সড়ক পথে চানপুর সাদা পাথর ছড়া, লাকমা ছড়া, বড়গোপ টিলা, শিমুল বাগানের যাতায়াতের সড়কের বেহাল অবস্থা।
এছাড়াও ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম নিয়েও অভিযোগ রয়েছে পর্যটকদের। সাইনবোর্ডে থাকা পুলিশের নম্বর বন্ধ থাকে বলছেন তারা।
ফেনী থেকে আসা পর্যটক মঞ্জুরুল ইসলাম সৌমিক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় আমরা পর্যটকেরা যেতে পারছি না। কক্সবাজার ও সিলেটের পর্যটন এলাকাগুলো চালু রয়েছে। গতকাল এসেছি। এসে রাস্তার বেহাল অবস্থা দেখেছি। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর আসার সড়কের বেহাল অবস্থা। নীলাদ্রি লেক (শহীদ সিরাজ লেক) থেকে অন্যান্য স্পটে যেতেও ভোগান্তি রয়েছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা অনেক কষ্ট করে আসতে হয়েছে। এগুলো পর্যটন এলাকার বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যারা এই ভোগান্তি শিকার করে একবার আসবেন দ্বিতীয়বার এখানে আসার উৎসাহ থাকবে না। তাই প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তিনি আরও বলেন, সারাদিন ঘুরলেও কোথাও ট্যুরিস্ট পুলিশ দেখিনি। এটি আমাদের জন্য ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাইনবোর্ডে দেওয়া ফোন নম্বরও বন্ধ।
অভিযোগের বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের সুনামগঞ্জ জোনের ইনচার্জ হাবিবুর রহমান বলেন, মোবাইল ফোনটি হাত থেকে পড়ে বিকল হওয়ায় কয়েকদিন বন্ধ ছিল। এখন ঠিক হয়েছে। নম্বর খোলা রয়েছে। আমরা ৮ জন সদস্য রয়েছি। ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক কাজ করছেন বলে দাবি করেন তিনি।
তবে ভোগান্তি নিয়েই সুনামগঞ্জের হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটছেন পর্যটকরা। ভ্রমণপ্রেমীদের নিয়ে হাওরের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত হাউজবোট। হাওরের বুকে আনন্দমুখর সময় কাটাচ্ছেন ভ্রমণপ্রেমীরা।
হৈমন্তী হাউজবোটের সিইও আরিয়ান ইমন বলেন, গত ২ মাসে আমাদের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য এলাকায় তিনটি জেলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় হাওরের দিকে পর্যটকেরা আসছেন। আমাদের প্রত্যেকটি বোট বুকিং শেষ হয়ে গেছে। অনেকে বুকিং দেওয়ার চেষ্টা করছে। হাওরে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।