প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত সিকৃবির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মশিউর
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে মশিউর রহমানের। সেই সূত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে যে প্রজ্ঞাপন জারি হয় সেটি তিনি আগে থেকেই জানতে পারেন। উপাচার্য পদে যিনি নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তার মোবাইল নম্বর জোগাড় করে শুরু হয় প্রতারণা। মশিউর নিজে ফোন দিয়ে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আত্মীয় পরিচয়ে শুরু করেন প্রতারণা। মাঝেমধ্যে তো হুমকি-ধমকিও দেন। উপাচার্য নিয়োগের কথা বলে তিনি নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবি করেন। এভাবেই নিজের প্রতারণার জাল বিছিয়েছেন মশিউর রহমান।
মশিউর রহমান আসলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কেউ নন। তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) ডেপুটি রেজিস্ট্রার। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে নানা প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ তুলেছেন কয়েকজন উপাচার্য। নিজেদের যোগ্যতায় নিয়োগ পেতে যাওয়া এই উপাচার্যদের কল দিয়ে তিনি বিভিন্ন দাবি জানিয়েছেন; বলেছেন নিয়োগটা তিনিই দেবেন, তবে নিয়োগের পর তার কথা শুনতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন উপাচার্য জানান, মশিউর রহমান প্রথমে ফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং উপাচার্য হওয়ার পর তার কথামতো চলার প্রতিশ্রুতি দিলে তবেই তিনি উপাচার্য বানাবেন বলে জানান।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দুজন উপাচার্য এই প্রতিবেদককের সঙ্গে কথা বলেন। প্রথমজন দাবি করেন, উপাচার্য হিসেবে তার প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে একাধিকবার কল আসে। ফোন রিসিভ করার পর ওই ব্যক্তি নিজেকে মন্ত্রীপরিষদ সচিবের আত্মীয় দাবি করে তাকে উপাচার্য বানিয়ে দেবেন এমনটি জানান। তবে শর্ত হিসেবে উপাচার্য নিয়োগের পর তার কথামতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ এবং তিনি যে নির্দেশনা দেবেন সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হবে এমনটি জানান।
আরেক উপাচার্য অভিযোগ করেন, মন্ত্রণালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়ে আগে থেকেই তাকে অবহিত করা হয়। যেদিন তার প্রজ্ঞাপন জারি হয় সেদিন সকাল থেকে মশিউর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তার শর্তে রাজি হলে উপাচার্য হিসেবে সেদিনই তার প্রজ্ঞাপন বের করে নিয়ে আসবেন বলে জানান।
কিন্তু মশিউর দাবি করেন, উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার পর তাকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিতে হবে। কিভাবে তিনি এমন কাজ করবেন জানতে চাইলে মশিউর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তার ভালো যোগাযোগ রয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার অপারেটর ও কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে মশিউর রহমানের। সেই সুবাদে উপাচার্য হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার আগেই তারা মশিউরকে তা জানিয়ে দেন এবং তিনি যোগাযোগ করেন।
এখানেই শেষ নয়, তিনি যেই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই সিকৃবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, মশিউর রহমান সরকার পরিবর্তনের আগে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে ছবি দেখাতেন এবং সুসম্পর্কের কথা জানাতেন। একইভাবে তিনি পট-পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও তার অনেক পরিচিত উপদেষ্টা আছেন বলে অন্যদের ভয় দেখান। এভাবে তিনি নানা সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন।
মশিউর রহমানের শিক্ষাজীবন নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। স্নাতকে দ্বিতীয় বিভাগে যারা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মশিউর ছিলেন একদম পেছনে। অথচ স্নাতকোত্তরে তিনিই হয়ে যান প্রথম বিভাগের টপার। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্ত তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী সেই তদন্ত মাঝপথে বন্ধ করে দেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. বাহালুল হক চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সিকৃবিতে নানা অভিযোগ
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনিয়ম করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মশিউর রহমান। তার বিরুদ্ধে অনিয়মের ফিরিস্তি অনেক লম্বা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মশিউর তৎকালীন উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। ওইসময় শিক্ষক, কর্তকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। সেজন্য তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) প্রদান করা হয়। এই অভিযোগে তাকে সেই বছরের ৮ অক্টোবর উপাচার্যের পিএস পদ থেকে সরিয়ে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের শিক্ষা শাখায় বদলি করা হয়।
শিক্ষা শাখায় থাকাকালীন গোপনীয় তথ্য ও নথি পাচার করার কারণে আবারো তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়।
২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সিকৃবির সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পিএস টু ভিসি পদের জন্য নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না মশিউরের। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে পিএস টু ভিসি পদের পরিবর্তে ২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল থেকে তাকে সেকশন অফিসার গ্রেড-১ পদে ডাউনগ্রেড দেখানো হয়।
পিএস টু ভিসি পদের নিয়োগ আদেশ বাতিল করে এমএস সনদ দাখিলের তারিখ হতে তাকে সেকশন অফিসার গ্রেড-১ পদ ধরে ২০১১ সালের ৮ এপ্রিল সহকারী রেজিস্ট্রার এবং ৭ বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল হতে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে পর্যায়োন্নয়ন করা হয়।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মশিউর রহমানের মোবাইলে কল দেওয়া হলে সেটি ব্যস্ত পাওয়া যায়।