জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট থেকে বেরিয়ে দুই সংগঠনের কমিটি!

সংগৃহীত ছবি

শুধু সংস্কৃতিচর্চা নয়, আন্দোলন-সংগ্রামেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ১১টি সংগঠনের সম্মিলিত প্ল্যাটফরম জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট। তবে সম্প্রতি সাংস্কৃতিক জোটভুক্ত দুটি সংগঠন বর্তমান কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি দুই সংগঠন মিলে তিন সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে।

যদিও নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিকে তারা জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের কমিটি বলেই আখ্যায়িত করছেন। যা নিয়ে আপত্তি বাকি ৯টি সংগঠনের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট। বর্তমানে ১১টি সংগঠন জোটভুক্ত। সেগুলো হলো ‘জলসিঁড়ি’, ‘সুস্বর’, ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (টিএসসি)’, ‘জাহাঙ্গীরনগর সিনে সোসাইটি’, ‘জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশন (জেইউডিও)’, ‘জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট সোসাইটি (জাডস)’, ‘চারণ’, ‘ধ্বনি’, ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (অডিটোরিয়াম)’ ও ‘জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ’।

২০২৩ সালের ১৪ জুলাই রাতে কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক জোটের সর্বশেষ কমিটি গঠিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী শরণ এহসান সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এক বছর মেয়াদী এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের জুলাইয়ে।

তবে দেশে তখন আন্দোলন চলার ফলে কাউন্সিল করে নির্বাচন দেওয়ার সুযোগ হয়নি বলে জানিয়েছেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি শরণ এহসান।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলার ফলে আমরা জোটভুক্ত সংগঠনগুলোর প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির জ্ঞাতার্থে আমরা সময় নিই। এজন্য সময়মতো কাউন্সিল ডাকা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া আগামী বৃহস্পতিবার আমরা একটি মিটিং ডেকেছি, যেটা মূলত কাউন্সিলের উদ্দেশ্যে।'

তিনি বলেন, ‌‘আমার মনে হচ্ছে তারা এ ব্যাপারটা জেনে তড়িঘড়ি করে এই প্রেসকনফারেন্স ডেকে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে, যা গঠনতন্ত্রবিরোধী।’

তবে গত রবিবার সন্ধ্যায় টিএসসির কনফারেন্স কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক পরাক্রম ও স্বকীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা, নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট প্রার্থীদের ট্যাগিং করে অপপ্রচার চালানো, গঠনতন্ত্রের লঙ্ঘন, যৌক্তিক আন্দোলনে নীরবতা, এবং অন্যায়কে ধামাচাপা দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে জোটভুক্ত দুটি সংগঠন তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।

এর পরপরই সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক জোটের নতুন একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ সময় জোটভুক্ত জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (টিএসসি) ও চিরকুট সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সাংস্কৃতিক জোটের কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক বান্না আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। কমিটিতে মাহফুজ ইসলাম মেঘকে আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব করা হয় জুবাইর জিয়ানকে। আর মুখপাত্র হয়েছেন প্রিয়াঙ্কা কর্মকার।

এ বিষয়ে মাহফুজ ইসলাম মেঘ বলেন, ‘আমরা অন্য সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করিনি তা না, অনেক সংগঠনের মৌন সমর্থন আমাদের সাথে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘শেষ মিটিংয়ে আমরা বলেছিলাম ১৬ ডিসেম্বরের পর এক সপ্তাহের মধ্যে একটা মিটিং ডাকুন, যেখানে আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলব। কিন্তু এক মাসের বেশি হয়ে গেছে তারা কোনো মিটিং ডাকেননি। তখনই আমরা বুঝতে পারছি যে একটা কোরাম এই জোটটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এই কোরামটা এতো সহজে ভাঙবে না। সে জায়গা থেকে কিভাবে সাংস্কৃতিক জোটের কার্যকরিতা বৃদ্ধি করা যায় সেই লক্ষ্যে এরকম একটা উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।’

তিনি এ-ও বলেন, ‘গঠনতন্ত্রে এটা উল্লেখ রয়েছে যদি সাংস্কৃতিক জোট নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় তখন এক বা একাধিক প্রজ্ঞা যোগ্যতাসম্পূর্ণ ব্যক্তি সাংস্কৃতিক জোটের দায়িত্ব নিতে পারবেন।’

এদিকে, জোটভুক্ত বাকি নয়টি সংগঠনের মধ্যে সাতটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলছেন তারা এ ব্যাপারে জানেন না; অফিসিয়ালি তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। জোটের আরো দুটি সংগঠন ‘জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশন (জেইউডিও)’ এবং ‘সুস্বর’ নেতৃবৃন্দও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত।

জেইউডিও এবং সুস্বর আরো চারটি সংগঠনের সঙ্গে একটি বিবৃতি দিয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গঠনতন্ত্রের ৮(ক) ধারা অনুযায়ী কার্যনির্বাহী পর্ষদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল পরবর্তী কার্যনির্বাহী পর্ষদ নির্বাচিত করবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে কার্যনির্বাহী পর্ষদ ক্রিয়াশীল না থাকলে ৮(চ) ধারা অনুযায়ী সাধারণ সভার নেতৃত্বেই সাংস্কৃতিক জোটের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

‘সকল সংগঠনের ঐকমত্য ব্যতীত নির্দিষ্ট কোনো আহ্বায়ক কমিটি গঠনের বিধান গঠনতন্ত্রে নেই। কাউন্সিল আয়োজনের আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় অন্য কোনো সংগঠনকে অবহিত না করে সাধারণ সভা ছাড়াই শুধুমাত্র জোটভুক্ত দুইটি সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (টিএসসি) ও চিরকুটের সদস্যদের নিয়ে নতুন করে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার বিষয়টি হঠকারী, গঠনতন্ত্রবিরোধী এবং দুঃখজনক।’

জাহাঙ্গীরনগর সিনে সোসাইটির সভাপতি অনুব্রত নন্দী বলেন, ‘আহ্বায়ক কমিটি যারা করেছেন তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি। আমরা এ বিষয়ে কিছু জানতাম না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা কোনো সাংগঠনিক কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমাদের কার্যকরী কমিটি বসে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।’

আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনির সহ-সভাপতি ফাইজা মেহজাবিন বলেন, ‘ধ্বনি আহ্বায়ক কমিটির ব্যাপারে কিছু জানে না। এটাকে আমরা জোটের কার্যক্রম হিসেবে বলতে চাই না।’

চারণের সোহাগী সামিয়া বলেন, ‘আমরা বর্তমান কমিটির সাথেই আছি, যেহেতু নতুনটার ব্যাপারে অবগত নই।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (জাডস) সভাপতি হাসিবুল হাসান রিশাদ বলেন, ‘নতুন করে কী হয়েছে জানি না। নির্বাচিত যে কমিটি সেটির সঙ্গে আমরা আছি। এই কমিটি যথাযথ নিয়ম মেনে নির্বাচন দেবে, যার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসবে। এটাই নিয়ম।’

জলসিঁড়ির সহ-সভাপতি সাদ্দাম হুসাইন রোহান বলেন, ‘আমরা কার্যকরি কমিটি বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে।’ 

জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের (অডিটোরিয়াম) সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া জাহান বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের (অডিটোরিয়াম) সাথে এ ব্যাপারে কোনো আলাপ আলোচনা বা আভাস দেওয়া হয়নি। পূর্বে যদি তারা আলোচনা করতেন তাহলে আমরা হয়তো আলোচনা করতাম। এখন আর আলোচনার সুযোগ নেই। আমরা যে সাংস্কৃতিক জোটে ছিলাম সে জায়গায় আছি।’

জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি মৌটুসী জুবাইদা রহমান বলেন, ‘তারা হুট করে একটি প্রেস কনফারেন্স করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করল। যেখানে মাত্র দুটি সংগঠন ছিল, বাকিদের কিছু জানায়নি। সাংস্কৃতিক জোটের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। আমাদের সংগঠন সেই জোটেই থাকবে।’

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া জাহান বলেন, ‘দুটি সংগঠন তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, তাদের বক্তব্য তারা তুলে ধরেছে, খুবই ভালো হতো যদি ফর্মালি মিটিংয়ে বসে তারা আমাদের এগুলো অবগত করতেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো কথা বলে এগুলো সমাধান করতে পারতাম। প্রেস কনফারেন্সে যেসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো নেহাতই টুইস্টেট এবং কিছু কিছু জায়গায় মিথ্যে কথা।’