জাবিতে বসন্তের আগমন, প্রকৃতিতে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া

‘পূর্ণিমা রাতে ঐ ছোটাছুটি করে কারা? দখিনা পবনে দোলে, বসন্ত এসে গেছে!’ জানালা ভেদ করে সূর্যের আলোকচ্ছ্বটা প্রবেশ করছে কক্ষে। পাখপাখালির কলতানে মুখরিত চারপাশ। শীতের আড়মোড়া ভেঙে, রুক্ষতা বিদায় করে, ফুলের সুবাসে, কোকিলের মিষ্টি মিহি সুরে ঘুম থেকে জেগে ওঠা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলো জনমানবশূন্য। শুষ্কতার আবেশে ঘোর রিদ্যতা। চারিদিকে শুনশান, নীরব-নিস্তব্ধতা।

আপন নীড়ে ফিরে গেছে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিব্রাজক পাখিরা। গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। সবুজের সমারোহ প্রাণ খুলে হাসতে শুরু করেছে। প্রকৃতি যেন তার রূপের ডালি মেলে জগৎবাসীকে জানান দিচ্ছে—শীতের ইতি ঘটেছে, ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে।

বসন্তের শুরুতে রূপ-লাবণ্যের সবটাই যেন প্রকৃতিপ্রেমীদের উজাড় করে দেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা-নিকেতন, মায়ার নগরী, বাসন্তী রানী, প্রকৃতিকন্যা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। গাছের ডালে ডালে ঝরে পড়া পাতার পর নতুন সবুজ কচি পাতার অঙ্কুর, কোকিলের কুহু কুহু ধ্বনি, পলাশ-শিমুলের রক্তিম আভা, সেইসঙ্গে গন্ধরাজের অমৃত সুবাসে ক্যাম্পাসের প্রতিটি আনাচ-কানাচে উৎসবের আমেজ বসন্তকে যেন আরও রূপবান করে তুলেছে।

কোকিল-শ্যামা গাছের ডালে বসে গাইতে শুরু করেছে। ভ্রমরেরা মেলেছে ডানা। আকাশে ভেসেছে মেঘের ভেলা। গাছে গাছে শিমুল-পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার মেলা। চারদিকে পরিবর্তনের ছোঁয়া। জাহাঙ্গীরনগরে লেগেছে তারুণ্যের হাওয়া। প্রকৃতি সেজেছে বর্ণিল সাজে।

বাংলা সাহিত্যে বিশাল স্থান অধিকার করে আছে বসন্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশসহ বহু কবি বসন্তের সৌন্দর্য, প্রেম ও প্রাণচাঞ্চল্যের কথা লিখেছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’

যদিও বৈশাখকে আহ্বান করে লেখা, তবুও এর ভেতরে বসন্তের এক ধরনের প্রস্তুতির বার্তা পাওয়া যায়।

Inner A

বসন্ত মানেই ফুলের সৌরভ আর প্রকৃতির বর্ণিল সাজ। পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বকুল, পারিজাতসহ নানা ফুলের সমারোহে চারদিক হয়ে ওঠে অপরূপ। আম, কাঁঠাল, লিচুর মুকুল চারদিকে ছড়িয়ে দেয় বসন্তের ঘ্রাণ।

বসন্তের সঙ্গে বাঙালির সখ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীনকাল থেকেই। এই সংস্কৃতিকে ধারণ করে এদেশের প্রতিটি প্রাণে সর্বদা আন্দোলিত হয় ফাগুনের স্নিগ্ধ সমীর। এই সময়টাতে জাহাঙ্গীরনগরের পথে-প্রান্তরে যেন উৎসবের আমেজ লেগে যায়।

হরেক রকমের রঙিন ফুলের সুবাসে চারদিক মোহিত হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে ক্যাম্পাসের একাধিক স্থানে তৈরিকৃত ফুলের বাগানগুলোও এ সময় যৌবনে পদার্পণ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হল-সংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনটি যেন বাংলার কাশ্মীর হয়ে নিজেকে মেলে ধরে এই সময়ে। বসন্তের আদরমাখা স্পর্শে জেগে উঠতে বাধ্য করে প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, শহিদ মিনার চত্বর, আবাসিক হল, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রসহ (টিএসসি) বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে বাহারি সব ফুলের বাগান। এখানে রয়েছে বিভিন্ন জাতের ফুলের সমারাহ। বসন্তের পরশে সেসব বাগানগুলোতে ফুটেছে অনিন্দ্যসুন্দর হরেক রকমের ফুল। গাঁদা, কসমস, বেলি, ডালিয়া, জিনিয়া, লাল-নীল-সাদা গোলাপ, মোরগঝুঁটি, সূর্যমুখী, জুঁই,  চামেলি, টগরসহ আরও নাম না জানা অগণন পুষ্পদল। জাহাঙ্গীরনগরকে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে এরাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আফরিন সুলতানা বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরে পড়তে এসেছিলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে। স্বপ্নের একটা ক্যাম্পাস ছিল এটি। তবে বসন্তকালে জাবি যে এতটা সুন্দরভাবে আবির্ভূত হয়, তা জানা ছিল না। আজকে সত্যিই বলতে হয়, জাবিতে ভর্তি হতে পেরে আমি গর্বিত। শুধু পাবলিকিয়ানদের জীবনেই নয়, বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে।’

বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে সবচেয়ে রঙিন, প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় ঋতু হলো বসন্ত। এটি ফাল্গুন ও চৈত্র মাসজুড়ে প্রকৃতিতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। শীতের বিদায়ের পর গ্রীষ্মের আগমনের আগমুহূর্তে এই ঋতুটি প্রকৃতিকে সজ্জিত করে অপরূপ রূপে।

বসন্তের রঙ, সৌরভ ও আনন্দ আমাদের মনকে উজ্জীবিত করে। তাই এই ঋতুকে যথাযথভাবে উপভোগ করা এবং এর সৌন্দর্যকে সুরক্ষিত রাখা আমাদের দায়িত্ব। তাই আসুন, বসন্তকে বরণ করি প্রাণ খুলে।

আবহমানকাল ধরেই বাঙালির সাথে বসন্তের এক অপরুপ মেলবন্ধনের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় ঐতিহাসিকদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে। বাঙালি আর বসন্ত একে অপরের সাথে যেন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বসন্তের অমিয় সুধা বয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এমনটাই প্রত্যাশা।