সিআরআই থেকে এটুআই দুর্নীতি : উঠে আসছে ব্র্যাকের আসিফ সালেহ্র নাম
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এসপায়ার টু ইনোভেইট (এটুআই) শীর্ষক ৮৫৫ কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়মের খোঁজে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে অভিযানও চালিয়েছে সংস্থাটি।
দুদক ও এটুআই প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এটুআই প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্।
তিনি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হোসেন আবেদের মেয়ের স্বামী। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। ছিলেন আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ম্যাগাজিন হোয়াইট বোর্ডের পরামর্শক পর্ষদের সদস্য।
সেই সুবাদে এটুআই প্রকল্পের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট হন আসিফ সালেহ্। গেল জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময়েও বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন আসিফ সালেহ্।
সরকার পতনের পর এটুআই প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তে নেমে যাদের খোঁজ পেয়েছে দুদক তাতে উঠে এসেছে ব্র্যাকের এই নির্বাহী পরিচালকের নামও।
এটুআইয়ের হেড অব প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট আব্দুল্লাহ আল ফাহিম বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মেলায় ইতোমধ্যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অনিয়মের পেছনে জয়-পলকের সম্পৃক্ততাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তখন এটুআই প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে আসিফ সালেহ্র কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’
দুদক জানিয়েছে, নির্দিষ্ট কোম্পানিকে বারবার কাজ দেওয়া, ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রকল্প নেওয়া ও ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে এটুআই প্রকল্পটির অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ (এটুআই) কর্মসূচি শুরু করা হয়।
পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১৮ সালে এটুআই প্রোগ্রামকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ২০২০ সালে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) নাম পরিবর্তন করে এসপায়ার টু ইনোভেইট (এটুআই) রাখা হয়।
সরকার পতনের পর এটুআই প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পায় দুদক। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইসিটি টাওয়ারে অভিযান চালানো হয়। সেখানে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দেড় শতাধিক কেনাকাটার দরপত্র যাচাই করে দুদকের দল। অভিযানে এটুআই প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছে অভিযানকারী দলটি।
সংস্থাটি বলছে, ‘প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ৪৮৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ধরা হলেও পরবর্তীতে এর ব্যয় দাঁড়ায় ৮৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা প্রাথমিক প্রজেক্টেড ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। অভিযানে অনিয়মের বিস্তারিত যাচাইয়ে নথি ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। সেগুলো বিশ্লেষণ করে পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
এই প্রকল্পে পিপিআরের বিধি লঙ্ঘন করে টেন্ডারগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। স্পেসিফিক/লজিক্যাল জাস্টিফিকেশন ছাড়া কার্যাদেশের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এর মাধ্যমে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে মর্মে দুদক প্রাথমিকভাবে মনে করছে।
তবে এসব বিষয়ে জানতে আসিফ সালেহ্র সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও সাড়া পায়নি দ্য মিরর এশিয়া। তার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
দুদক মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘প্রকল্পে অনিয়মের ঘটনায় যাচাই-বাছাই শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সিআরআইয়ের অন্যতম কুশীলব
রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কৌশলগত সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সিআরআই। দলীয় এ থিংক ট্যাংকটিতে শেখ পরিবারের সদস্যদেরই আধিক্য; যাদের হাত ধরে প্রকাশিত হতো নীতিবিষয়ক প্রকাশনা হোয়াইট বোর্ড।
এই প্রকাশনার পরামর্শক পর্ষদে ছিলেন আসিফ সালেহ। আওয়ামী লীগের পক্ষে সফট পাওয়ার তৈরির প্রকল্প সিআরআইয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। পরিচিতি উপস্থাপনায় তাকে লেখক, প্রযুক্তিবিদ ও একজন সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে উল্লেখ করেছে সিআরআই।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই কর্মসূচির একজন নীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন আসিফ। গোল্ডম্যান স্যাক্সের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা আসিফ আইবিএম, গ্লাক্সো ওয়েলকাম ও নরটেলের জন্যও কাজ করেছেন। স্নাতক করেছেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেস থেকে।
তিনি ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ারও চেষ্টা করেন তিনি।
১৯ জুলাই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দেন আসিফ সালেহ্। তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লিখেছিলেন, ‘ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জেনেছি যে আটজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন রাবার বুলেটবিদ্ধ। তবে আহতদের মধ্যে কতজন ইউনিভার্সিটির ছাত্র তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। আহতদের অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’
সালেহ তার স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘এখন আশপাশের ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্র জড়ো হয়েছেন ক্যাম্পাসের সামনে। খুবই উত্তেজনাময় পরিস্থিতি।’
কিন্তু সেই সময়ে ফেসবুক, বিবিসি এবং একটা বেসরকারি চ্যানেলে প্রকাশ হয়ে যায় যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ড্র্রাইভার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু সত্য গোপন করে সালেহ তার ফেসবুকে বলার চেষ্টা করেন, ওই সংঘাতের ঘটনায় একজন নিহত হওয়ার যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে তার কোনো সত্যতা নেই।
তিনি বলেন, ‘অনলাইনে একটি খবর বেরিয়েছে যে ইউনিভার্সিটির একজন ড্রাইভার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এটি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের জানামতে সত্য নয়। গুজব ছড়ানোর সময় না এখন।’
৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে পরিচিত আসিফ সালেহ্ ব্র্যাকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের প্রত্যক্ষ সহযোগী ও গণহত্যার সমর্থকদের নিয়োগ দিয়ে রক্ষা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার পক্ষাবলম্বনকারী ও এর স্বপক্ষে প্রচারণাকারী কয়েকজন এখন ব্র্যাকে চাকুরি করছেন।
আরও পড়ুন : শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও সক্রিয় সিআরআই
আরও পড়ুন : সিআরআই’র নামে আইএফআইসি ব্যাংকে ৩৫ কোটি টাকার এফডিআর