আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও বিচারে দুই উপদেষ্টার বিরোধিতা

সংগৃহীত ছবি

গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার শুরু করতে না পারাকে অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা বলে মন্তব্য করছেন রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তবে ছাত্রদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার একটি আল্টিমেটাম দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা তো দূরের কথা, দলটিকে নির্বাচনে আনার প্রশ্নে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং এনসিপি এখন মুখোমুখি অবস্থানে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা এবং প্রধান উপদেষ্টাকে আটকের গুজব ছড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর ধরে দেশে গুম-খুন চালিয়েছে। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যা সংঘটিত করেছে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগের অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকার তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগও এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছিল শেখ হাসিনার পতনের অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর পরদিনই নির্বাহী আদেশে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

তবে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে দুই উপদেষ্টা সরাসরি এর বিরোধিতা করেন। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রয়াত বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ এবং শিল্প উপদেষ্টা ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবে সম্মতি দেননি।

মূলত এই দুই উপদেষ্টার বিরোধিতার কারণেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রস্তাবে কোনো দলের বিচারের প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়। এ কারণে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও বিচার করার বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। এই দুই উপদেষ্টার পাশাপাশি আরো এক উপদেষ্টা আওয়ামী লীগকে শুদ্ধরূপে ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা দ্য মিরর এশিয়াকে জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন : জুলাই হত্যাকাণ্ডে ১,৪০০ জন নিহত

জাতিসংঘ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের আলোকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে গণহত্যার দায়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র নেতাদের মতে, গুম-খুনের বিচার না হলে জুলাই শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি হবে।

একটি অডিও ক্লিপে শোনা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বিচারে গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই নির্দেশ সরকারি বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো বাস্তবায়ন করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জোরপূর্বক ক্ষমতায় টিকে থাকতে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালানো শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে হবে। গণহত্যায় জড়িত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘তদন্ত হয়েছে এবং আমরা যা জানতাম, তা-ই নিশ্চিত হলাম। তার এই ভয়ঙ্কর অপরাধগুলো, যা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে, সেগুলোর বিচার করতে হবে।’

ছাত্র নেতারা বলছেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ গত ১৫ বছরের সব খুনের বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে ভোটাধিকার হরণ, গুম-খুনের বিচার না করলে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে না।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ বনাম স্থানীয় নিষ্ক্রিয়তা

সম্প্রতি সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ গণ-আন্দোলনের মুখে পালিয়ে গেছেন। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে যান, যার ফলে তার দল বাথ পার্টির কয়েক দশকের ক্ষমতার অবসান ঘটে। এখন তার দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে দেশটির ডি ফ্যাক্টো সরকার। কিন্তু গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কেন অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না—এ প্রশ্ন উঠেছে।

রাজনীতিবিদরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ার সুযোগ এনেছে। তবে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের প্রভাব রয়ে গেছে। ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য শিক্ষিত মেধাবীদের রাজনীতিতে আসতে হবে। নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসে তরুণদের নেতৃত্ব দিতে হবে, যারা জুলাই অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।

জনঅস্থিরতা ও জবাবদিহির দাবি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ দুর্বল হওয়ায় তারা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদকেও সংস্কার করা জরুরি।

দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করলেও সরকার ব্যবস্থা নিতে পারছে না। গুপ্তহত্যা ও সহিংসতা চলমান থাকলেও প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। একদিন আগে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দাবিতে ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে মিছিল করে। এ ঘটনায় এক নারীসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ।