মেজর আফিজের রহস্যময় মিডিয়া দখল

শেখ হাসিনার পাশে মেজর (অব.) আফিজুর রহমান

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মেজর (অব.) আফিজুর রহমানের আকস্মিক ও জোরালো পুনঃপ্রবেশ প্রশ্ন ও উদ্বেগ উসকে দিয়েছে। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) সাবেক এই কর্মকর্তা বর্তমানে ‘পেশাদার নেতৃত্বের’ আড়ালে একাধিক সংবাদমাধ্যম দখলের অভিযোগের মুখে।

জনকণ্ঠের মতো প্রভাবশালী দৈনিকে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ— এই দুই কৌশলের পেছনে রয়েছে কি শুধুই একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার কর্মজীবনের নতুন অধ্যায়? নাকি এটা রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ দখলের জন্য নির্বিচারে চালানো অপারেশনের অংশ?

জনকণ্ঠ দখল: সহিংসতা, দমন ও নীরবতা

এই ঘটনাপ্রবাহের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অধ্যায় হচ্ছে জনকণ্ঠ পত্রিকা দখল। এই ‘হস্তান্তরের’ সময় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও জনকণ্ঠের নিউজরুম ইনচার্জ আফজাল হোসেনকে মারধর করে তার পদ থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়া হয়।

২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজিব হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আফজাল এই দমন-পীড়নের প্রতীকী শিকার। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জনকণ্ঠ কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় পরিবেশ ছিল থমথমে। বিনিময়ে কোনো সংলাপ নয়, ছিল শুধু ভয়-ভীতি প্রদর্শন।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন, ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত জনকণ্ঠ ভবনের ভেতরেই এই হামলা চালানো হয়। এতে এনসিপি নেতা আরিফুর রহমান তুহিন এবং জনকণ্ঠের ‘প্ল্যানিং অ্যাডভাইজর’ জয়নাল আবেদীন শিশিরের নাম উঠে আসে। যদিও ‘প্ল্যানিং অ্যাডভাইজর’ নামে সাংবাদিকদের মজুরি বোর্ডে কোনো পদ নেই।

জয়নাল আবেদীন শিশির সাংবাদিকদের একটি সংগঠন ‘জার্নালিস্টস এগেইনস্ট ফ্যাসিজম’-এর প্রধান, যার আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকেছেন।

এই সিন্ডিকেট কর্তৃক দখলকৃত নতুন জনকণ্ঠ টিম বর্তমানে পত্রিকাটির বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল সংগ্রহ করছে, যা অনেকের কাছে ‘চাঁদাবাজি চক্রের’ মতো মনে হচ্ছে।

দ্য মিরর এশিয়া যখন এনসিপি নেতা আরিফুর রহমান তুহিনের কাছে এই দখল অভিযান সম্পর্কে জানতে চায়, তিনি বলেন, ‘আমি কিছু জানি না।’

পরে জানান, তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি আবু সালেহ আকনের নির্দেশে সেখানে গিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে দ্য মিরর এশিয়া ডিআরইউ সভাপতির সঙ্গেও যোগাযোগ করে। তিনি জানান, ‘আমি ফোন দিয়ে তুহিনকে বলেছিলাম— একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে দেখ।’

তবে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, তুহিন শুধু জানতেনই না, বরং পুরো দখল অভিযানের নেতৃত্বেই ছিলেন। জনকণ্ঠ ভবনে হামলার সময় তার উপস্থিতিও বহু প্রত্যক্ষদর্শী নিশ্চিত করেছেন।

এটিই প্রথম নয়, আরও একটি প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক দখলের সময়ও তুহিনের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ উঠেছিল। সেই সময়ও কোনো তদন্ত হয়নি, ঘটনাটি ‘চুপিসারে’ মীমাংসা করা হয়।

দখল-পরবর্তী নীরবতা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি

এসব ঘটনার পরও তদন্ত হয় না, বিচার হয় না। বরং সৃষ্টি হয় এক ধরনের ভয়ংকর নীরবতা। এটা সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে।

গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জনকণ্ঠ দখল কেবল শুরু। মেজর (অব.) আফিজুর রহমান আরও অন্তত পাঁচটি সংবাদমাধ্যম নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করছেন। এসব পরিকল্পনার আড়ালে রয়েছে তথাকথিত ‘গঠনমূলক সংস্কার’ ও ‘সম্পাদনা পুনর্বিন্যাস’-এর কাহিনী।

ডিজিএফআই অতীত: নিয়ন্ত্রণ, নিপীড়ন ও সেন্সরশিপ

আফিজুর রহমানের বিতর্কিত অধ্যায় শুধু সাংবাদিকতা জগতেই নয়। ডিজিএফআইয়ে তার দীর্ঘ কর্মজীবনে বহু সাংবাদিক ও সম্পাদক তাকে সমীহ করতেন। অভিযোগ আছে দুর্নীতির কারণে ডিজিএফআই থেকে তার চাকরি চলে যায়। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) ও ডিআরইউ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতেন বলেও অভিযোগ আছে।

তাকে অমান্য করলে কোনো প্রার্থী হতেন হয়রানির শিকার, কেউ কেউ নিখোঁজও হয়েছেন। একসময় ডিআরইউ-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদকে ২৪ ঘণ্টার জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আরেক টিভি সাংবাদিককে কার্যালয়ের সামনে থেকে ধরে নিয়ে ৮ ঘণ্টা আটকে রেখে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব ঘটনার কোনোটিরই তদন্ত হয়নি, কোনো বিচার হয়নি।

বেতন আন্দোলন ও সিওও আফিজের ভূমিকা

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনকণ্ঠে সাংবাদিক ও কর্মীদের বেতন বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে ‘জনকণ্ঠ সাংবাদিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ’ গঠন করে তারা ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করেন।

কিন্তু জনকণ্ঠের প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা (সিওও) মেজর (অব.) আফিজুর রহমান শুরু থেকেই এই আন্দোলন দমনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠদের উচ্চ বেতনে নিয়োগ দিতে থাকেন। বকেয়া বেতন আটকে রেখে নতুন নিয়োগ দেওয়ায় অসন্তোষ চরমে পৌঁছে।

৪ মে সাংবাদিক ও কর্মীরা পত্রিকার ভবনের সিঁড়িতে অবস্থান কর্মসূচিতে গেলে রাত ৮টার দিকে ৫০-৬০ জন বহিরাগত ও কিছু নতুন কর্মী মূল ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। ঐক্য পরিষদের সভাপতি আফজালকে চিহ্নিত করে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়।

রাত ৯টার দিকে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় ‘প্ল্যানিং অ্যাডভাইজর’ জয়নাল আবেদীন শিশিরের অফিসে। সেখানে তার সামনে আবারও মারধর করে একটি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে ভবন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

সেদিন আরও পাঁচজন সাংবাদিককে ছাঁটাই করা হয়। তারা হলেন তপন বিশ্বাস, শংকর কুমার দে, গোলাম মোস্তফা, রুমেল খান এবং শামসুল আলম সেতু। পরদিন অফিসে ফেরার চেষ্টায়ও তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

জনকণ্ঠের প্রায় ২০০ কর্মী সারা দেশে কাজ করেন। ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে ৪ মে ২০২৫ পর্যন্ত দশ মাস ধরে কোনো বেতন দেওয়া হয়নি। কেউ ৫ মাস, কেউ ৪ মাস ধরে বেতন পাননি। ৩০ বছরের ইতিহাসে ৯০ শতাংশ কর্মীর কোনো পদোন্নতি হয়নি, নিয়মিত বেতনবৃদ্ধিও হয়নি।

মেজর (অব.) আফিজুর রহমান ২৫ জুলাই ২০২৪ সালে জনকণ্ঠে সিওও হিসেবে যোগ দেন।

নিউজরুমের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ

আফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিলেও সাংবাদিক মহলে তার ছায়া রয়ে গেছে। অনেকে বলছেন, তিনি নিজে কিংবা তার প্রতিনিধি মিডিয়া হাউসে গিয়ে হুমকি দিতেন। ২০২৩ সালে ছাত্র আন্দোলনের আগে তিনি বিভিন্ন মহলে প্রচার করতেন, ‘তরুণ বা সিভিল সোসাইটির রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো ভূমিকা নেই।’

তিনি দৈনিক বাংলা, নিউজবাংলা২৪-এর নির্বাহী ভূমিকা পালন করছেন। গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারে সিওও হিসেবে দায়িত্বে আছেন। পাশাপাশি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সমন্বয়কারী হিসেবেও কর্মরত। গোপালগঞ্জের পৈতৃক বাড়ির অধিবাসী ও পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফতের ফিল্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মেজর (অব.) আফিজুর রহমান। কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদের ওপর নির্যাতনের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে মুশতাক কারাবন্দি অবস্থায় কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।

ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও ভিন্ন বিবরণ

নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ যতই গুরুতর হোক না কেন, নিজেকে আফিজুর রহমান উপস্থাপন করেন এক সততাবান ও স্বপ্নবাজ পেশাদার হিসেবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়ে তিনি তার জীবনের নানা অধ্যায় তুলে ধরেন— সেনা জীবন, শিক্ষাজীবন ও মিডিয়ায় নেতৃত্ব।
ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘জীবনে চলতে হয় সততা, উদ্দেশ্য ও ভালোবাসা নিয়ে।’ শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন বলেও দাবি করেন।

নায়ক না নিপীড়ক? দ্বৈত বাস্তবতা ও গণমাধ্যমের অস্তিত্ব সংকট

এই দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যে দুলছে বাংলাদেশ। একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এখন মিডিয়াকে রূপান্তর করছেন কীভাবে? মিডিয়া বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে একাধিক সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ আসা গণতন্ত্রের জন্য গভীর হুমকি।

প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি এবং সাংবাদিক ইউনিয়ন সবাই কোথায়? এত অভিযোগের পরও কেন তদন্ত হয় না? কেন আফজালদের মতো সাংবাদিকরা এখনো বিচারের অপেক্ষায়?

আরও একটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ ,এটা কি কেবল একজন দক্ষ পেশাজীবী কর্ম জীবনের পরিণতি? নাকি এটা এক অদৃশ্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয় পুনর্প্রবেশ, যা কখনো হয়রানি শুধু রূপ বদলেছে?

দ্য মিরর এশিয়া ফোনে যোগাযোগ করলেও মেজর (অব.) আফিজুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।