‘ইচ্ছা করে’ সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা করছে ভারত

বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের টহল

সীমান্তবর্তী এলাকায় মাঝেমধ্যেই শোনা যায় বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা। পার্শ্ববর্তী ‘বন্ধু রাষ্ট্রটির’ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে প্রাণ হারান বাংলাদেশিরা। এমনকি, দেশটির নাগরিকরাও এই হত্যায় জড়িত হয়ে পড়ছেন। তবে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই উঠতি বয়সী। অধিকাংশ ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সীমান্ত দিয়ে গরু আনতে গিয়ে বাংলাদেশি যুবকরা প্রাণ হারাচ্ছেন। অনেক সময় বাংলাদেশ সীমান্তে এসেও গুলি করছে বিএসএফ। যদিও এসব ঘটনায় কড়া জবাব দিতে দেখা যায়নি ঢাকাকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে মাদকসহ আরও নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। তবে বিএসএফ বেছে বেছে গরু চোরাচালানে জড়িতদের হত্যা করছে। যারা গরু চোরাচালানের মূলহোতা তারাও থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু হত্যা করা হচ্ছে সীমান্ত পার করার কাজ করা যুবকদের।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের পক্ষ থেকে বছরের পর বছর আশ্বাস দেওয়া হলেও আদতে তা বন্ধ হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, হত্যাকাণ্ড বন্ধে বাংলাদেশকে যেভাবে সোচ্চার ও প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। ফলে সীমান্তে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে ভারতীয়রা।

জানা গেছে, গত মে মাসে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্তে দুই যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করে বিএসএফ। সর্বশেষ গত ২ জুন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তে নুরুজ্জামান নামে বাংলাদেশি এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। স্থানীয়দের ধারণা- মাছ ধরতে যাওয়া ওই যুবককে ভারতের খাসিয়ারা হত্যা করেছে।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল- ৯ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক ২৭৭ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩ জুন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৪ জন বাংলাদেশি।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে- সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, বাস্তবতা আসলে এসব কথার বিপরীত। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ একটি নতজানু রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত থাকা ভারত কেবল বাংলাদেশের নাগরিকদেরই হত্যা করছে। অথচ, তারা চাইলে এ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারে।

এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, গরু চোরাচালানের অভিযোগ তুলে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। এটিতো কেবল বাংলাদেশের মানুষ করছে না। সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে গরু এনে জমা করে দেশটির বড় বড় ব্যবসায়ীরা। তারপর সেটি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। এটি দৃশ্যমান প্রক্রিয়া। ভারত যদি এটি বন্ধ করতে চাইতো তাহলে তারা সেখানে হাত দিত। তা না করে তারা সাধারণ মজুরদের হত্যা করে।
 
হত্যাকাণ্ডের শিকার অধিকাংশই বয়সে তরুণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো গরু ব্যবসায়ীকে কখনো শুনিনি হত্যা কিংবা আটক করা হয়েছে। যাদের মারা হচ্ছে তারা সবাই টাকার বিনিময়ে গরু পারাপারের কাজের সঙ্গে যুক্ত। 

গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের সর্বশেষ বৈঠক। ওই বৈঠকেও সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গটি উঠে আসে। দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সীমান্ত হত্যাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে বলেন, সরকার সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে। প্রাণহানি যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে আমরা ভারতের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করছি।

সীমান্ত হত্যা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় ভারত বিষয়টিকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে বলেও মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তারা বলছেন, আগে কখনো শুনিনি সীমান্তে ভারতীয়রাও মারা যাচ্ছে। কিন্তু কিছু দিন হলো তারা সেটি বলার চেষ্টা করছে। সেখানে যদি কোনো চোরাকারবারি মারা যায় সেটি তাদের সীমান্তরক্ষীদের হাতে। বাংলাদেশের বিজিবিতো (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) কাউকে মারছে না। সুতরাং, তাদের বিষয়টি অভ্যন্তরীণ। আর আমাদের বিষয়টি আন্তর্জাতিক।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কূটনীতিক মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আমি বহুবছর ধরে এ নিয়ে কথা বলে আসছি। পৃথিবীর এমন কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ দুটি দেশ নেই যেখানে চোরাচালানের কারণে গুলি করে মারা হয়। শুধু কি গরু চোরাচালান হয়? আর কিছু হয় না? শত শত কোটি টাকার ফেনসিডিল চোরাচালান হয়। কোনোদিন তো শুনিনি কোনো ফেনসিডিল চোরাকারবারি গুলিতে নিহত হয়েছে। কাজেই এটি সিলেকটিভ এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনায় কেউ আহত হয় বলে শুনি না, সবাই মারা যায়। তার মানে, মেরে ফেলার উদ্দেশ্যেই গুলি করা হয়। অপরাধ পৃথিবীর সবখানেই ঘটে। তার মানে এই না যে আপনি গুলি করে মেরে ফেলবেন। আহত যদি হত তাকে ধরে নিয়ে আদালতে ওঠানো হতো। বিচারক বিচার করতেন। একটা নির্দিষ্ট সময় কারাভোগ করে সে বেরিয়ে আসতো। সরকার এ ব্যাপারে কোনো শক্ত অবস্থান নিতে পারবে বলেও মনে করেন না সাবেক এ কূটনীতিক।