তীব্র গ্যাস সংকটে রাজধানীর সিএনজি স্টেশনে অচলাবস্থা

মাসখানেক ধরে রাজধানীর সিএনজি স্টেশনগুলোতে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। এতে পরিবহন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লোকসানের মুখে পড়ছেন স্টেশন মালিকরা। তারা কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেন না। মঙ্গলবার (১১ জুন) দুপুরে রাজধানীর কয়েকটি সিএনজি স্টেশন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।  

বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর শাহবাগ এলাকার পূর্বাচল ট্রেডার্সের মালিকানাধীন গ্যাস স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সেটি ফাঁকা। শুধু কয়েকটি মোটরসাইকেলকে তেল নিতে দেখা গেছে। ক্যাশ কাউন্টারসহ আশপাশে ছায়ায় বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন কর্মীরা। 

সেখানে কথা হয় স্টেশনটির কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। দ্য মিরর এশিয়াকে তিনি জানান, রমজানের একমাস গ্যাসের বেশ চাপ ছিল। এরপর ধীরে ধীরে তা কমেছে। সম্প্রতি গ্যাস নেই বললেই চলে। 

ক্ষুব্ধ মোশাররফ বলেন, ‘১৯৭৪ সাল থেকে এই সেক্টরে কাজ করি। এখনকার মতো অচলাবস্থা আগে কখনো দেখিনি। জিয়াউর রহমানের আমল দেখেছি। খালেদা জিয়ার আমল দেখেছি। শেখ হাসিনার আগের আমলগুলোও দেখেছি। কিন্তু এখনকার সময়ের মতো খারাপ সময় আগে দেখিনি। চারদিকে এক ধরনের হাহাকার চলছে। মানুষের গলা টিপে ধরা হয়েছে। সমস্যার মধ্যে আছি, কিন্তু বলতে পারছি না। এভাবে দেশ চলতে পারে না।’  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় ৭০টির মতো সিএনজি স্টেশন আছে। সেগুলোতে বাই রোটেশন গ্যাস দেওয়া হয়। কিন্তু ভিআইপি এলাকার স্টেশনগুলো ছাড়া অন্য স্টেশনে গ্যাসের সরবরাহ নেই। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন বেলা ১১টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে স্টেশনগুলোতে গ্যাসই আসছে মধ্য রাতে; যখন রাস্তায় কোনো গাড়ি থাকে না। আর বেলা ১১টার পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যখন গ্যাস থাকার কথা তখন লাইনে কোনো গ্যাস পাওয়া যায় না। এ কারণে গাড়ির লাইন থাকলেও গ্যাস দেওয়া যায় না। 

গ্যাসের অভাবে কোনো কোনো ফিলিং স্টেশন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। রাজধানীর সাত রাস্তা মোড়ের আকিজ ফিলিং স্টেশন গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক আয় গড়ে ১০ লাখ টাকা, এখন কেবল খরচ গুনতে হচ্ছে।

এদিকে যেসব এলাকার সিএনজি স্টেশনে গ্যাস থাকছে, সেগুলোতে গাড়ির লম্বা লাইন লেগে আছে। সোমবার নিকুঞ্জ এলাকার একটি স্টেশনে সিএনজি অটোরিকশাসহ প্রাইভেট গাড়ির ব্যাপক ভিড় লক্ষ করা গেছে। 

আব্দুল করিম নামে একজন প্রাইভেট গাড়িচালক জানান, গ্যাসের জন্য গভীর রাতে গাড়ি নিয়ে বের হতে হয়। কয়েকটা স্টেশন ঘুরলে তারপর কোনো একটায় পাওয়া যায়। বেশ কিছুদিন এভাবে চলতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।  

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে যে দুটি ভাসমান টার্মিনাল রয়েছে, তার মধ্যে সামিট গ্রুপেরটি ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২৭ মে থেকে তাই এখানে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

জানা গেছে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ হয় সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৩১০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি। মহেশখালীতে একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহ নেমেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে।

সামিট গ্রুপ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত টার্মিনালটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর বা মধ্যপ্রাচ্যে নিতে হবে। চলছে তারই প্রস্তুতি। মেরামত শেষে তিন সপ্তাহের মধ্যে এটি ফিরিয়ে আনা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাভার জোনাল অফিসের ব্যবস্থাপক আবু সালেহ মোহাম্মদ খাদেম উদ্দিন বলেন, আমাদের সোর্স সাপ্লাই লাইনে চাপ ৫০ পিএসআই থাকার কথা থাকলেও এখন তা ২০ পিএসআইয়ের আশপাশে। এতে করে সাপ্লাইয়ে সমস্যা হচ্ছে। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভাসমান টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। সেই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। যে কারণে উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য উপযোগী এমন অবকাঠামো নির্মাণ হওয়া উচিত।