ড. ইউনূস কেন লোহার খাঁচায়!

ঢাকার শ্রম আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বছরের ৯ নভেম্বরের ছবি। এএফপি

শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়মিতই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। অনেকগুলো বিচারের মুখোমুখি তিনি। জেল খাটার মতো সাজা ভোগ করতে হতে পারে বলে খবর বের হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। এর মধ্যে সাজাও ঘোষণা হয়েছে। যদিও ড. ইউনূসসহ অনেকে বলছেন, বর্তমান সরকারের রোষানলের ভুক্তভোগী তিনি।

রাজনীতিকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরোধটা বেশ পুরোনো। এক-এগারোর প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনীতিতে আসার যে ইচ্ছা ড. ইউনূসের ছিল, তা হয়তো ভালোভাবে নেয়নি আওয়ামী লীগ। 

তাদের বক্তব্য, টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ এখন ড. ইউনূসের বিষয়টিও সিরিয়াসলি নিয়েছে। গত বছরের আগস্টে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে একে একে ১৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ১৬০ জন বিশ্বনেতা ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি ক্ষমতাসীনরা, বরং সমালোচনা করেছে। উল্টো ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শ্রম আইন লঙ্ঘনের যে মামলা তার বিরুদ্ধে হয়েছিল, সেটিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬ মাসের সাজা পান ড. ইউনূস।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দেড় দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমর্থন পাওয়া ড. ইউনূস বহুবার দেশের রাজনৈতিতে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন। এমনও মনে করা হয় যে, তাকে ঘিরে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশে ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তার কিছুই হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্্উ ইউনূসের মামলা ঠেকাতে পারছে না। 

সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ড. ইউনূসের লড়াইটা অনেকটা সাপে-নেউলে। দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের জ্যেষ্ঠ অনেক নেতাকে প্রকাশ্যে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

সম্প্রতি দুদকের দায়ের করা মামলায় আদালতে তার বিরুদ্ধে শুনানি চলছে। এ কারণে বেশ ঘনঘন হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। তবে হাজিরার পুরো সময়টা তাকে এজলাসের লোহার খাঁচায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। যাকে বেআইনি ও অপমানজনক উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ড. ইউনূস।

তিনি বলেছেন, ‘এ বিষয়ে সবাই মিলে একটু আওয়াজ তুলুন, যাতে বিষয়টা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। একটা সভ্য দেশে কেন এ রকম হতে যাবে! আদালতে শুনানিকালে কেন একজন নাগরিককে খাঁচার ভেতরে পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। যেখানে এখনও বিচার শুরুই হয়নি, যেখানে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার কোনো সুযোগই হয়নি। নিরপরাধ নাগরিককে কেন খাঁচার ভেতরে থাকতে হবে এ প্রশ্নটা তুললাম।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি আগেও প্রশ্নটা তুলেছি, আবারও সবার জন্য তুলছি। আমার বিষয় না, যেকোনো আসামি; যার বিরুদ্ধে এটা করতে যাচ্ছে, তাকে খাঁচায় নিয়ে যাওয়া। আমি যতটুকু জানি, যত দিন আসামি অপরাধী প্রমাণিত না হচ্ছে, তত দিন তিনি নির্দোষ-নিরপরাধ। একজন নিরপরাধ নাগরিককে একটা লোহার খাঁচার ভেতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আদালতে শুনানি চলাকালে, এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক। অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে মনে হয়েছে।’

এদিকে বিচার চলাকালে অভিযুক্তকে লোহার খাঁচায় বন্দি রাখার বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যেও আলোচনা চলছে।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ড. ইউনূস বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। পৃথিবীতে যাকে সবাই সম্মান করে। বিভিন্ন দেশের মিউজিয়ামে এই বাংলাদেশির নাম রয়েছে। এই ব্যক্তিটিকে সরকার যেভাবে হয়রানি করছে তা অকল্পনীয়। এটি যারা করছে তাদের সম্মান নষ্ট হচ্ছে, সরকারেরও সম্মান নষ্ট হচ্ছে। তার সম্মান নষ্ট করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের সম্মান নষ্ট করছে। 

ড. ইউনূস নোবেল পদক পাওয়ায় সরকার তার প্রতি ঈর্ষাকাতর উল্লেখ করে সিনিয়র এ আইনজীবী আরো বলেন, ড. ইউনূস নিজেই নিজেকে নোবেল দেননি। নোবেল কমিটি আছে তারা তাকে যোগ্য বিবেচনা করে দিয়েছে। এ জন্য তার প্রতি তাদের হিংসা-বিদ্বেষ হতে পারে, লোকজন এটা বলছে। আমি মনে করি তার প্রতি এই হয়রানি বন্ধ করা উচিত। 

আদালতে অনেকেরই বিচার হয়, সবাইকে কি ওই খাঁচার ভেতরে ঢোকায়- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি আরো বলেন, অথচ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো লোককে খাঁচার ভেতরে ঢুকিয়েছে। অপমানের একটা সীমা থাকা প্রয়োজন। আমরা আসলে কাউকে সম্মান দিতে জানি না। 

এদিকে ড. ইউনূসকে এজলাসে লোহার খাঁচায় ঢোকানোর বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলেছে। এতে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ।

গত বুধবারও দুদকের মামলায় লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। বুধবার দুপুর ১১টা ৫ মিনিটে আদালতে প্রবেশ করেন ড. ইউনূস। হাজিরা নেওয়ার জন্য বিচারক ড. ইউনূস ও পারভীন মাহমুদ ছাড়া সবাইকে লোহার খাঁচায় প্রবেশ করতে বলেন। তবে অন্যদের সঙ্গে ড. ইউনূসও ১১টা ৪৭ মিনিটে লোহার খাঁচায় প্রবেশ করেন। লোহার খাঁচায় দাঁড়িয়েই অভিযোগ গঠনের আদেশ শোনেন তিনি। আদেশ শেষে ১২টা ৩ মিনিটের দিকে লোহার খাঁচা থেকে বের হয়ে আসেন ড. ইউনূসসহ অন্য আসামিরা।

বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, সরকার তার (ড. ইউনূস) সঙ্গে যে আচরণ করছে সেটা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।

তিনি বলেন, ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ব্যক্তিকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে তার সঙ্গে বেআইনি আচরণ করা হচ্ছে। যে কারো বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে। যে কাউকেই আদালতে যেতে হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত তার নাগরিকদের সম্মান রক্ষা করা। ড. ইউনূসের বেলায় সেটা হয়নি।