এক আইএমইআই নম্বরেই চলছে দেড় লাখ মোবাইল ফোন

মোবাইল ফোন। প্রতীকী ছবি

প্রতিটি মোবাইল ফোনের জন্য ১৫ সংখ্যার একটি স্বতন্ত্র আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টি) নম্বর থাকলেও দেশে শুধু একটি আইএমইআই নম্বরের নিবন্ধন দিয়েই দেড় লাখেরও বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরএনবি (টেলিকম এন্ড টেকনোলজি রিপোর্টারস নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ) আয়োজিত এক সেমিনারে এমন তথ্য তুলে ধরেন মোবাইল অপারেটর রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম। 

অবৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেট নিয়ে এমন বিস্ফোরক তথ্য শুনে সেখানে উপস্থিত ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক আঁতকে উঠে বলেন, ‘কী বলেন! এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।’

এসময় প্রতিমন্ত্রী সেমিনারে উপস্থিত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের উদ্দেশে বলেন, ‘অবৈধ হ্যান্ডসেট প্রতিরোধ করতে হবে। আমি গোয়েন্দা প্রধানকে বলব, যেন বাজারে থাকা অবৈধ হ্যান্ডসেটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়।’

প্রসঙ্গত, আইএমইআই নম্বর প্রত্যেক ফোনের জন্য আলাদা এবং এই সুনির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে মোবাইল নেটওয়ার্কে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মোবাইলের অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব। এই নম্বরটি মূলত মোবাইল হ্যান্ডসেটটির পরিচয় বহন করে। যার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয় যে ফোনটি কোন এলাকায় ব্যবহার করা যাবে এবং কোন ফ্যাক্টরিতে এটি তৈরি হয়েছে। সাধারণত হ্যান্ডসেট হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে এই আইএমইআই নম্বরের মাধ্যমে হ্যান্ডসেটটির অবস্থান খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি আরও কিছু তথ্য জানা যায়।

‘দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওই সেমিনারে শাহেদ আলম বলেন, ‘ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্টার (এনইআইআর) কার্যকর না হওয়া এবং গ্রে-মার্কেটের কারণে আমাদের জন্য একটি মোবাইল ডিভাইস লকিং গাইড লাইন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই গাইডলাইন কোনো কাজে আসছে না। কেননা এর শর্তগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক। সেটে থাকা দুটি সিম স্লটের মধ্যে একটি বন্ধ রেখে আরেকটা চালু রাখার ক্ষেত্রে এটা কাজ করছে না।’

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এনইআইআর বাস্তবায়ন করে উজবেকিস্তানে ৭০০ শতাংশ রাজস্ব বেড়েছে। আজারবাইজানের  শতাংশ হ্যান্ডসেট এখন নিবন্ধিত হয়েছে। নিবন্ধন জটিলতার কারণে বাংলাদেশে এনইআইআর বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। 

মোবাইল উৎপাদনকারীদের পক্ষ থেকে কর ইনসেনটিভ প্রদান, চোরাই পথে ফোন আসা বন্ধ করার দাবি তোলা হলে এসব বিষয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীকে দেবেন বলে জানান টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী।

দেশে ব্যবহৃত নিবন্ধিত মোবাইল ফোনের ডাটাবেইজ বিটিআরসিকে সংরক্ষণ এবং তা প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এনবিআর এবং ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে তাৎক্ষণিক সরবরাহেরও নির্দেশ দেন পলক।

সেমিনারে জানানো হয়, হ্যান্ডসেট সংযোজনে বর্তমানে দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ১৭টি প্রতিষ্ঠান। ১৬ হাজার কোটি টাকার হ্যান্ডসেটের বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ লাগেজ-ব্যাগেজে আনা অবৈধ মোবাইল ফোনের দখলে। এতে বছরে ১ হাজার কোটি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। টিকতে না পেরে স্মার্ট ও ফিচার ফোন মিলিয়ে উৎপাদন সক্ষমতার ৩০ শতাংশ অব্যবহৃত থাকছে। এভাবে চলতে থাকলে কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে হবে হ্যান্ডসেট উৎপাদকদের।

ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘দেশে অবৈধ মোবাইল ফোন ছড়িয়ে দেয় যারা তাদের বিরুদ্ধেও ডিবি সারাদেশে কাজ করতে আগ্রহী। এ নিয়ে যখন অভিযান করি, তখন দেখি আপনাদের মতো এমন অফিস বানিয়ে চীনসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ এনে তারা এ মোবাইলগুলো বানাচ্ছে। দুই-তিন মাস চালানোর পর তা নষ্ট হয়ে যায়।

‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের ধরতে সক্ষম হচ্ছি। যদি সংশ্লিষ্ট খাত থেকে আমাদের সহযোগিতা করা হয়, তাহলে সেটা ঢাকার মধ্যে হোক কিংবা বাইরে- আমরা অপরাধীদের ধরবোই। ইন্ডিয়াতে খুন করলেও আমরা ধরে ফেলি। ওমানে অপরাধ করলেও ধরে আনি,’ বলেন তিনি।

ডিবিপ্রধান বলেন, ‘আমরা প্রায়ই দেখি বিমানবন্দরে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে লাখ লাখ মোবাইল ফোন দেশে ঢুকে পড়ে। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কম দামে সেগুলো ভিন্নপথে দেশে আনা হচ্ছে। রাজধানীর মোতালেব প্লাজা, গুলিস্তান পাতাল মার্কেট, যমুনা ফিউচার পার্কসহ নামীদামি মার্কেটে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে কর ফাঁকির ফোন। মোতালেব প্লাজায় যাবেন, দেখবেন সেখানে একটা আইএমইআই দিয়ে ৫০টা মোবাইল ফোন তৈরি করছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। একই সঙ্গে দেশীয় মোবাইল ফোন উৎপাদনকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

টিআরএনবির সভাপতি রাশেদ মেহেদীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, বিটিআরসির মহাপরিচালক মনিরুজ্জামান জুয়েল, বাংলালিংক ডিজিটালের চিফ কর্পোরেট এন্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান, এমটব মহাসচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার, টিআরএনবি সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রবিন প্রমুখ।

সেমিনারের শুরুতে দেশের মোবাইল ফোনের উৎপাদন, বাজার পরিস্থিতি, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করেন মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইওবি) সভাপতি জাকারিয়া শহীদ।