সেইন্ট মার্টিনের কাছে বার্মার যুদ্ধসাজ

ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ব্যবহারকারী উদ্বেগ সহকারে প্রশ্ন করছেন, বাংলাদেশের দক্ষিণপ্রান্তের কোরাল দ্বীপ সেইন্ট মার্টিনে কী ঘটছে?

বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে, সপ্তাহ আগে থেকে সেইন্ট মার্টিনগামী নৌযান লক্ষ্য করে গুলি করা হচ্ছে। তখন থেকে সেইন্ট মার্টিন কার্যত টেকনাফ  থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বাংলাদেশের নৌযানকে লক্ষ্য করে কারা গুলি করছে, এ বিষয়ে দায়িত্বশীল মহল সুনির্দিষ্ট তথ্য না দিলেও স্থানীয়দের ধারণা বার্মার রাষ্ট্রীয় বাহিনীই গুলি করছে। এরই মধ্যে বার্মার বিমান সেইন্ট মার্টিনের ওপর দিয়ে উড়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন স্থানীয়রা। 

দ্বীপটির প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর মিলছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলোর নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমগুলো সেইন্ট মার্টিনের খবর ব্ল্যাক আউট করেছে।

কিন্তু কেন এই অবস্থান নিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো?

সংবাদমাধ্যমগুলো সে সামান্য তথ্য দিচ্ছে তাতে স্পষ্ট, সেইন্ট মার্টিনের অধিবাসীরা বার্মার জান্তা ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে সংকটে পড়েছে। রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করে আরাকান আর্মি এখন ওই রাজ্যটির রাজধানী সিতওয়ে দখলের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। নাফনদী তীরবর্তী অঞ্চলে তীব্র লড়াই চলছে বলে গোলাগুলি থেকে অনুমান করছেন স্থানীয়রা।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাফ নদী হয়ে টেকনাফ-সেইন্ট মার্টিন জলপথে যাতায়াতকারী ট্রলার ও নৌযানগুলোতেও গুলি এসে পড়েছে। নৌযানে গুলি হওয়ার পর বিজিপি এই রুটে চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সেইন্ট মার্টিন। সেখানকার দোকানগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিশপত্রের সরবরাহ কমে আসছে। সেখানে খাদ্যসংকট তৈরি হতে পারে বলে আভাস দেওয়া হচ্ছে। কারা বাংলাদেশের বেসামরিক নৌযানে গুলি করছে তা জানাতে সংবাদমাধ্যমগুলো কার্পণ্য করছে, অনেক সময় ধোঁয়াশাও সৃষ্টি করছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গুলি জান্তা বাহিনী নিয়ন্ত্রিত জাহাজ থেকে আসছে। সেইন্ট মার্টিন-টেকনাফ নৌপথ সংলগ্ন এলাকা এখনও জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।

বৃহস্পতিবার দিনের দ্বিতীয়ার্ধে গোলাগুলি কিছুটা কমে এলে ঈদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে টেকনাফে ফিরতে চাওয়া কিছু মানুষকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিকল্প পথে সেইন্ট মার্টিন থেকে স্থানান্তর করা হয়। কিছু মানুষ নিজস্ব উদ্যোগেও বিকল্প পথে বঙ্গোপসাগর হয়ে টেকনাফে ফিরেছেন। তবে এই পথ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন পার হওয়া ব্যক্তিরা। নৌযান ডুবে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা ব্যাপক। কিন্তু জান্তা বাহিনীর উপস্থিতির কারণে নাফ নদীর নৌপথ চলাচলের উপযুক্ত নেই। বাংলাদেশের নৌযান দেখলেই তারা গুলি করছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন।

টেকনাফে ফিরে আসা একজন প্রত্যক্ষদর্শী দ্য মিরর এশিয়াকে জানান, তিনি জলপথে আসার সময় নাফ নদীর বার্মা সীমান্তে জান্তা বাহিনীর অনেক জাহাজ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পান। তার হিসাবে পুরে নাফ নদী জুড়ে প্রায় বারোটি যুদ্ধজাহাজ সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো আছে। টেকনাফ-সেইন্ট মার্টিন রুটে বেসামরিক নৌযানে গুলির ঘটনা সে জাহাজগুলো থেকেই হয়েছে বলে স্থানীয়রা বলছেন। বার্মার এই রণসজ্জার বিপরীতে বাংলাদেশের মাত্র দুটি যুদ্ধজাহাজ দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে, বার্মার এত জাহাজ কেন সেইন্ট মার্টিনের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান নিয়েছে সে বিষয়ে স্থানীয়রা নিশ্চিত নয়।

শাহপরীর দ্বীপ এলাকা থেকে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বিরামহীনভাবে গোলাগুলি চলছে। নাফ নদীর সারবাংয়ের বিপরীত তীরবর্তী অঞ্চলে তীব্র গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

টেকনাফ থেকে খাদ্য ও জরুরি সামগ্রী নিয়ে একটি জাহাজ সেইন্ট মার্টিনে যাওয়ার কথা থাকলেও বুধ ও বৃহস্পতিবার সেটি যেতে পারেনি। চরম অস্থিরতার মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় দশদিনের খাদ্য পৌঁছেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। শুক্রবার (১৪ জুন) সকালের দিকে কক্সবাজার জাহাজ ঘাট থেকে এই খাবার পৌঁছানো হয় বলে স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে। এর আগে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, নদীপথে বিকল্প উপায়ে সেখানে খাদ্য সরবরাহের চেষ্টা চলছে।  

জানা গেছে, বার্মার জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান সংঘর্ষের ফলে গত ফেব্রুয়ারি থেকে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছিলো প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। সম্প্রতি সেখানকার খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করায়  দ্বীপটির ১০ হাজারের অধিক বাসিন্দার খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পতিত হয়। সংকট চলাকালে বিকল্প পথে কক্সবাজার থেকে সেইন্ট মার্টিন রুটে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হবে বলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছেন।

নাফ নদী সংলগ্ন মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় তীব্র যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আক্তার কামাল বলেন, পূর্বদিকে মিয়ানমারে রাখাইনের মংডুতে হাসসুরাতা ও মেরুল্ল্যা গ্রাম থেকে বুধবার দিনভর ব্যাপক মর্টারশেলের শব্দ পেয়েছেন তারা। এতে বাড়িঘর কেঁপে ওঠে। এ সময় আকাশে যুদ্ধবিমান এবং সাগরের জলসীমানায় দেখা যায় বার্মার যুদ্ধজাহাজ। দ্বীপবাসী খুবই আতঙ্কে রয়েছেন। কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না।

আরাকান আর্মির আক্রমণে কোণঠাসা জান্তা বাহিনী কেন বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে নাফ নদীর কাছে অবস্থান জোরদার করেছে এবং বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা করছে? এ প্রশ্নে উত্তরে একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক জানান, মূলত বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করতেই তারা এ অবস্থা নিয়ে থাকতে পারে। তবে সীমান্তের কাছে বার্মা বাহিনীর উস্কানিমূলক অবস্থানকে হালকা করে দেখার কিছু নেই। বাংলাদেশকে অবশ্যই ওই অঞ্চলে উপস্থিতি বাড়াতে হবে। বেসমারিক লোকদের জানমাল ও জীবনযাপনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, সেইন্ট মার্টিন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অপ্রচার চলছে তা হতাশাজনক। সেখানে জান্তাবাহিনীর উপস্থিতি ও বার্মার গৃহযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়লেও, বাংলাদেশের অনেক নাগরিক কাল্পনিক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের নীরবতা মানুষকে ভুল দিকে পরিচালনা করছে। মানুষকে সঠিক তথ্য দিতে বিজিবি ও আইএসপিআর-এর সক্রিয় হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

স্থানীয় আরেকটি সূত্র জানায়, আরাকান আর্মি শুরু থেকেই সন্দেহ করে আসছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ঢুকে জান্তা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করে, বাংলাদেশ সরকার দেশটির জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় জাহাজ, ট্রলার ও নৌকা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে যাচ্ছে জান্তা বাহিনী। এ অবস্থায় তারা বাংলাদেশি জাহাজগুলিকে বন্দুকের গুলির আওতায় নিয়ে আসে। এরপর থেকেই টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপে জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

সূত্রটি আরো জানায়, আগে ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে যুদ্ধ ছিলো। এখন সেটি নাফ নদীর ওপারে হচ্ছে। ফলে তা সাবরাং, শাহপরী দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে প্রভাব ফেলছে। এখানকার বাসিন্দারা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। 

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, গত ৫ জুন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের বহনকারী একটি ট্রলারে বার্মার ও প্রান্ত থেকে  প্রায় ২৫-৩০টি গুলি চালানো হয়। এরপরই  জাহাজ  চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। দেশটিতে চলমান সংঘর্ষের কারণে শাহপরী দ্বীপের বাসিন্দারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। সীমান্ত থেকে মর্টার শেল এবং গোলাগুলির বিকট শব্দ শোনা গেছে। যা আতঙ্ক আরো বাড়াচ্ছে। 

এদিকে শুক্রবার সকালেও সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে সাগরে টহলরত যুদ্ধজাহাজ দেখা গেছে। এতে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয়রা।