দুর্নীতি ফাঁস হওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশ বাহিনীতে

সম্প্রতি পুলিশ বাহিনীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবরে তোলপা চলছে।

সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, পুলিশের ডিআইজি জামিল হাসান, এসবি’র অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার খবর ব্যাপক আলোচনা ও নিন্দা-প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যপ্রমাণ সমৃদ্ধ এসব খবরে পুলিশ বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের সব পর্যায়ে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে কে কখন কার তথ্য ফাঁস করে দেয় সেই আতঙ্ক চলছে। ভয়ে আছেন শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের অনেক আলোচিত কর্মকর্তা। এদের মধ্যে আরও কয়েকজন আলোচিত কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

নাম প্রকাশের ভয় থেকেই পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন তড়িঘড়ি সভা আয়োজন করে সরকারের কাছে গণমাধ্যমকে চাপে রাখার দাবি তুলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে দ্য মিরর এশিয়া আলাদাভাবে কথা বলেছে। কথা হয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কয়েক জন কর্মকর্তার সঙ্গেও। এদের প্রায় সবার বক্তব্যেই স্পষ্ট যে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার সঙ্গে থেকে অনেক কর্মকর্তা নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। কারও কারও মতে, ভাগ-বাটোয়ারার দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে দুর্ণীতির বিষয়গুলো সামনে চলে আসছে।

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, যিনি সরকারী কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেন তিনি দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, অধিকাংশ আমলার ফাইলই সরকার প্রধানের টেবিলে দেওয়া হয়েছে। এদের সকলেই কোনো না কোনোভাবে অনিয়মের সাথে জড়িত। বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসন ক্যডারের কর্মকর্তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা ফাইল আছে; যা সরকার প্রধান অবগত। মাঝে মধ্যে, দু’একটি বিষয় সামনে চলে আসছে। এগুলো কারো নির্দেশে সামনে আনা হচ্ছে না। বরং একই বিভাগের সহকর্মী বা অধস্থন কর্মকর্তারাই বের করে দিচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে ওই পরিচালক বলেন, বাহিনীর ভেতরেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব  ও প্রতিযোগিতা আছে; সেই প্রতিযোগিতার মাঝে পড়ে যাচ্ছেন অনেকে। তারাই ফেঁসে যাচ্ছেন। যতটুকু সামনে আসছে, অনিয়ম-দুর্নীতি তার চেয়েও বহুগুন বেশি। 

দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, বহু সরকারী কর্মকর্তার বিষয়ে প্রতিনিয়তই অভিযোগ পাচ্ছি। সবগুলো আমলে নেওয়াও হয় না। আমাদের লোকবলের সীমাবদ্ধতা আছে। যতগুলো অভিযোগ আসে, তদন্ত করলে এর অধিকাংশেরই হয়তো সত্যতা পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, অন্তত শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে দুদকে অভিযোগ রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। দুদক মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে তদন্ত কার্যক্রম চালায় বলে জানান দুদক সচিব। এ জন্য গণমাধ্যমকে আরো বেশি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এ কারণেই পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন বিবৃতি দিয়ে গণমাধ্যমকে এক ধরনের চাপে রাখতে চাইছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, হয়তো তাই।  

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ মে মেহেদী হাসান নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়। মেহেদী হাসান বর্তমানে নাটোর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কর্মরত।

কনস্টেবল নিয়োগে ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মাদারীপুরের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) সুব্রত কুমার হালদারসহ তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে দুদক।

জ্ঞাতআয় বহির্ভূত ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় পুলিশের বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানকে ২০২৩ সালের ২১ জুন ১৪ বছরের সাজা দিয়েছে আদালত।

এছাড়াও সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি শেখ হেমায়েত হোসেন, অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলী আশরাফ ভূঁইয়া, উপ-পুলিশ কমিশনার হামিদুল আলম, পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ, পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন, খুলনা বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের সাবেক ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. সহিদ হোসেন, ইন্সপেক্টর আবুল বাশার, ইন্সপেক্টর জাবেদ মাসুদ, ইন্সপেক্টর মো. রাসেল, এসআই বাবুল ইসলাম, রূপগঞ্জের ইন্সপেক্টর মাহমুদুল হাসান, এসআই মো. আইয়ুব আলী ও এসআই মনিরুজ্জামানসহ অন্তত অর্ধশত পুলিশ সদস্যের জ্ঞাতআয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।

দুদকের ওই সূত্রটি আরো জানিয়েছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে শাখা কর্মকর্তা, ব্যাংকের উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পড়ে আছে। প্রতি তিন মাস পর পর এসব অভিযোগ থেকে যেগুলো আমলে নেওয়া হয় না, সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়। যেগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তার মধ্যে শত শত সত্য অভিযোগ চাপা পড়ে যায়। উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা জনবল সংকটের কথা বললেও, বিষয়টি শুধু স্বল্প জনবলের কারণে হয় না। কিছু উচ্চ কর্মকর্তার সুবিধাবাদী মনোভাব ও লোভের কারণেও অনেক অভিযোগ ধামাচাপা পড়ছে।

রাজারবাগ পুলিশ টেলিকমে কর্মরত এডিশনাল ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশে দীর্ঘ দিন ধরে দু’টি গ্রুপ। এক গ্রুপ বেনজিরপন্থী। আর এক গ্রুপ গোপালগঞ্জের বাইরের ক্ষমতাধরদের গ্রুপ। এই দুই গ্রুপের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব বাঁধে। যখনই দ্বন্দ্ব বাঁধে তখনই কারো কারো দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসে। মূলত, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনরে পর থেকেই পুলিশের প্রায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পদ বাড়তে শুরু করে। গত দুই নির্বাচনে পুলিশই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে সরকারের চেয়ে পুলিশ বেশি ক্ষমতাধর হয়ে গেছে। আর তাদের সম্পদও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।

ওই কর্মকর্তার হিসেব বলছে, এসআই থেকে শুরু করে আইজিপি; এদের মধ্যে প্রায় সকলেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। আর এদের কারো টাকাই শাদা নয়। সবই কালো টাকা।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, সর্বত্রই সুশাসনের অভাব রয়েছে। যাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার কথা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার কথা, তাদেরকেই দুর্নীতির মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা এসব দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে সবচেয়ে বেশি সহায়ক বলে মনে করেন তিনি।

সাবেক আইজিপি কে এম শহিদুল হক দ্য মিরর এশিয়ার কাছে এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বলেছেন, দায়িত্বে যারা রয়েছেন, এ দায় তাদের, মন্তব্যও তাদের করা উচিত।

--