চীন চায় মোংলা-পায়রা, বাংলাদেশও চায় অনেক কিছু

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে বর্তমানে বিশ্বের ৮২ দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে চীনের সঙ্গে। ইপিবির তথ্য থেকে জানা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী চীনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। যার পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলার।  ২০২২ সালে বাংলাদেশে চীনের রপ্তানি ছিল ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। সে বছর চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল এক বিলিয়ন ডলারেরও কম। বিপুল পরিমাণ এ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কৌশল গুরুত্ব পাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে। একই সঙ্গে চীনও বাংলাদেশে অর্থনীতি ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে চায়।  

এ জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষ করে অবকঠামো খাতে বিনিয়োগ ও অংশগ্রহণ বাড়াতে চায় দেশটি। এসব বিষয়ও গুরুত্ব পাবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের সূচিতে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন ও সুনীল অর্থনীতির বিকাশ ও পায়রা এবং মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলো স্থান পাবে আলোচনায়। 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে কেন্দ্র করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। কেন না স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের আগেই ২০২৬ সালের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করা হবে।

সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন এই সফরে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নানা বিষয় প্রাধান্য পাবে। এর পাশাপাশি সমকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় ভূরাজনীতির বিষয়টি দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় স্থান পাবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরো বেশি শক্তিশালী করে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনগুলোর কীভাবে সমাধান করা যায় সে বিষয়েও আলোচনা করা হবে। একক মুদ্রা হিসেবে ডলারের আধিপত্য কমাতে চীনা মুদ্রার প্রচলন আরো কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়টি স্থান পাবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরের দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারকসহ (এমওইউ) ১১টি দলিল স্বাক্ষরিত হতে পারে। যেগুলোর খসড়া ইতেমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে-চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই), বাণিজ্য সহায়তা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, ডিজিটাল অর্থনীতি, সুনীল অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সমীক্ষার ঘোষণা ও একাধিক মৈত্রী সেতু নির্মাণ ও সংস্কার।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে চীনের আগ্রহ থাকবে পাওয়া ও মোংলা সমুদ্র বন্দরের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশেষ করে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগে (সিডি) চীনের অংশীদারত্ব কিংবা সহযোগিতার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে।

জানা গেছে, মোংলা বন্দর আধুনিকায়ন, আঞ্চলিক বাণিজ্য, যোগাযোগসহ এই বন্দরের সুবিধাদি বৃদ্ধি ও নানা কার্যক্রমের প্রসঙ্গ থাকছে আলোচ্য সূচিতে। এর আগে চলতি বছরের শুরুতে মোংলা বন্দরের সক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ছয়টি নতুন জেটি নির্মাণের প্রকল্পও হাতে নেয় সরকার। যা ইতিমধ্যে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় চীনা সহায়তা ও অর্থায়নে দুটি জেটি নির্মাণের চুক্তিও করা হয়েছে। কাজ শুরুর প্রতীক্ষা করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনসট্রাকশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি)।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মোংলা। দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এ সমুদ্রবন্দরের সুবিধাদি বাড়িয়ে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে জেটি নির্মাণ, কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ভূরাজনৈতিক জটিলতাসহ নানা কারণে বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। এসব ইস্যুও গুরুত্ব পাবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায়।

এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় চীনের বিনিয়োগের আকর্ষণ করতে চায় সরকার। ইতিমধ্যে চীন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা পায়রা, মোংলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে পরিদর্শনও করেছেন।

পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে সিডির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে আঞ্চলিক সংযুক্তির কেন্দ্র গড়ে তুলতে সরকার মনোযোগ দিচ্ছে। একইভাবে সরকার মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্রে রেখে পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সহায়তাও চেয়েছে সরকার।

বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের একটি সূত্র আরো জানায়, মিয়ানমারের সঙ্গে চলামন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চীনের সহায়তা চাওয়া হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা হতে পারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে যেকোনো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে ব্রিকসে (বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট) যুক্ত করতে চীনের সহায়তা চাওয়া হবে। ব্রিকসে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সদস্যদেশ বা অংশীদার রাষ্ট্র যেভাবেই হোক, সেটা নিয়ে তাদের সমর্থন চাওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন চাইলে বাংলাদেশ এই জোটে যুক্ত অত্যন্ত সহজ হবে। আর বাংলাদেশ এই জোটে যুক্ত হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ বাণিজ্য ও অন্যান্য ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বিভিন্ন দেশ ও জোটের সঙ্গে দর কষাকষির নতুন এক প্ল্যাটফরম খুলবে বলে মনে করে চায়না বাংলা চেম্বার অব কমার্সের মূখপাত্র আল মামুন মৃধা। 

তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। এটা সত্যি। আবার চীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে এটাও সঠিক। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে আরো বেশি ভূমিক রাখবে বলে তিনি মনে করে।

উল্লেখ্য-গত মাসের শেষ দিকে ভারত সফরে দুই সপ্তাহ পর আগামী ৮ জুলাই রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় এক দশক পর দ্বিপক্ষীয় এই রাষ্ট্রীয় সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি রাজনীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বেইজিং ও ঢাকা।