চীন-ভারত পেয়েছে প্রকল্প, বাংলাদেশের প্রাপ্তি ‘শূন্যের কোঠায়’

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারত ও চীন নিজেদেরকে বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন সহযোগী’ দাবি করে বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ও ব্যবসার অনুমোদন পেয়ে আসছে। অথচ বাংলাদেশের প্রাপ্তি অনেকটা শূন্যের কোঠায়।

কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে আওয়ামী লীগ গত তিনটি নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশের অনুগামী হয়ে ক্ষমতায় আসায় পারস্পরিক সহযোগিতার বিপরীতে ‘একদলীয় শাসন’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঢাকায়।

নিয়মিত সীমান্ত হত্যা চলছে, তিস্তার অসম পানি বণ্টনে বাংলাদেশ খরা ও বন্যার শিকার হয়ে অনেকটা নিশ্চুপ থাকছে এক দশক ধরে। সাম্প্রতিক অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই বার দিল্লী সফর ও সর্বশেষ বেইজিং সফরে অনেকটা ‘চাপ’ অনুভব হয়েছে শেখ হাসিনার।

এক মাসে দুইবার দিল্লী সফর করা শেখ হাসিনার ‘ভারসম্যপূর্ণ কূটনীতির’ পরীক্ষায়  গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বেইজিং সফর। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিংপিং ২০১৬ সালে যখন ঢাকায় আসেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত করতে ২৪ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেইজিং থেকে মেলেনি কোনো সহযোগিতা।

আওয়ামী লীগ ভারতকে ‘রাজনৈতিক’ সহযোগী মনে করায় তার সাথে বোঝাপড়ার অংকে অনেকটাই নিশ্চুপ থাকতে হয় দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে।  

অর্থনীতির নির্দেশকগুলো যখন এক দশক ধরে নিম্নগামী, ডলার সংকটে চাপে থাকা রিজার্ভকে টেনে তুলতে আইএমএফের কাছে যাওয়ার আগে চীনের উপর ভরসা রাখে আওয়ামী লীগ। প্রতিশ্রুতির ২৪ বিলিয়নের আলোচনা ৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে গত কয়েক মাসে। বুধবারে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং-শেখ হাসিনার বৈঠকে আলোচনায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় সামনে এলেও মুল প্রত্যাশা ছিলো ঋণের ঘোষণা।

তবে লি কিয়াং বাংলাদেশের জন্য ১ বিলিয়ন ইউয়ান ঋণ দেয়ার ঘোষণা করলেন যার মার্কিন ডলার মুল্যমান মাত্র ১.৩৭ মিলিয়ন। অনেকটা হতাশা নিয়ে বেইজিং ছাড়তে হয় শেখ হাসিনাকে। তার ওপর ভারত সরকার ও মিডিয়ার সার্ভিলেন্স তো আছেই।

সর্বশেষ বেইজিং সফর শেষ করে ঢাকায় ফিরেছেন নির্ধারিত দিনের আগেই। ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রী রাধা দত্তের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেকটা ‘ডিসঅ্যাপয়েনন্টেড’ মনে হয়েছে বেইজিং আলোচনায় ফলপ্রসূ কোন ফলাফল না আসায়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য, ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্ধু, চীনকে দরকার অর্থনীতির জন্য। শেখ হাসিনার নয়া দিল্লি সফরে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর হলেও ঋণের বিষয়টি সামনে আসেনি। আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে তিস্তা ও আঞ্চলিক রেল অবকাঠামো উন্নয়ন। দিল্লির সঙ্গে বোঝাপড়ায় নিশ্চুপ থেকে আর্থিক সুবিধা পেতে বেইজিংয়ের পথে হেঁটেছেন শেখ হাসিনা। তবে ফলাফলটা আশাব্যাঞ্জক হয়নি ঢাকার জন্য।

এক মাসের মাথায় দিল্লি ও বেইজিং ঘুরে এসে ‘ভারসম্যের কূটনীতির’ গল্প শোনানো চেষ্টা থাকবে সরকারের। তবে বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রাপ্তি অনেকটাই শূন্য। বেইজিং সফরের আগে তিস্তা প্রকল্প, রোহিঙ্গা সমস্যা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য চীনের ঋণ নিয়ে মিডিয়া ক্যাম্পেন হলেও দুই দেশের নেতাদের শীর্ষ বৈঠকের ‘যৌথ বিবৃতি’ এসেছে অনেকটা ‘প্রশংসা বাণী’ হিসেবে। তিস্তা থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা কোনো সমাধানই আসেনি বাংলাদেশের জন্য।

অধ্যাপক শ্রী রাধা বলেন, বাংলাদেশ চায়নাকে অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে বিবেচনার চেষ্টা করছে, তবে ঢাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনায় বেইজিংয়ের উপস্থিতি অনেক আগে থেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ফ্রান্সের সাথে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ শুরু করায় হয়তো বেইজিং নাখোশ।

দ্য মিরর এশিয়াকে এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলেন, বাংলাদেশে ভারত ও চীন নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলো বের করে নিয়ে গেছে, শুধু এই দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি না, অন্যান্য সুপার পাওয়ার ইউএস-রাশিয়ারও বাংলাদেশকে দরকার প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য।

তারপরও বাংলাদেশের প্রাপ্তি অনেকটা অনুপুস্থিত। অধ্যাপক রাধার ধারণা ঢাকার এখন অর্থনীতির যে অবস্থা, সেটা পুনঃরুদ্ধারে চীন ও ভারত কারো কাছ থেকে প্রত্যাশিত সমাধান পাননি হাসিনা। তিনি বলেন, এবারে শেখ হাসিনা আরএমজিতে বিনিয়োগ আশা করেছিলেন, সেটা পাননি, বিআরআইভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে হিস্যা সেখানে প্রমিজ এবং ডেলিভারসের একটা গ্যাপ আছে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চীন ও ভারত থেকে নতুন অর্থায়নের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না বলে জানা গেছে ইআরডি সূত্রে। অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও দেশ দুটি থেকে নতুন কোনো অর্থায়নের খবর পাওয়া যায়নি। সে অনুযায়ী, গত এক বছরে চীন ও ভারত থেকে নতুন কোনো অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি আসেনি।

দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের প্রভাবিত করে বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন নিজ নিজ দেশের নির্ধারিত ঠিকাদার দিয়ে। বাংলাদেশিরা শুধু শ্রম দিয়েছে অদক্ষ শ্রমিক শ্রেণিতে। ফলাফল বিদেশি ঋণের ফাঁদে পড়েছে এদেশের সাধারন মানুষ।

দক্ষিন এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আকর্ষণ করতে প্রেসিডেন্ট শির ২০১৬ সালে ঢাকা সফরে ২৫ বিলিয়ন ডলার সমমুল্যের সহায়তাসহ ২৭ প্রকল্প ঘোষণা করে চীন। সে থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেইজিংমুখী হতে থাকে এক দশক ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা আওয়ামী লীগ।

ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অধীনে বাংলাদেশকে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রথম এলওসি চুক্তি হয়। পরে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আরো দুটি এলওসি চুক্তি হয়। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এসব চুক্তির বিপরীতে অর্থায়ন মিলেছে দেড় বিলিয়ন ডলারের কম। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় চুক্তির বিপরীতে অর্থছাড় ধীরে হচ্ছে। চুক্তির শর্ত নিয়েও রয়েছে জটিলতা।

এসব চুক্তির শর্ত নিয়ে বেশ কয়েকবার দরকষাকষিও করতে হয়েছে ঢাকাকে। এবারের সফরেও চুক্তির শর্ত শিথিল করা নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো পরিবর্তনের ঘোষণা সামনে আসেনি।