ভারতের চাপ সত্ত্বেও চীনের সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ

আঞ্চলিক দুই পরাশক্তির সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে বেইজিং সফর করা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের চাপের মুখে পড়লেও চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বাংলাদেশ এবং চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে সহযোগিতামূলক ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’কে আরো একধাপ এগিয়ে নিল শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বেইজিং সফর। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিংয়ে বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণাপত্র আসে দুই দেশের পক্ষ থেকে।

বুধবার চীনের প্রভাবশালী পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস হাসিনার বেইজিং সফরকে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের ‘নতুন যাত্রা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। যদিও কিছু ভারতীয় মিডিয়া এই সফর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

গ্লোবাল টাইমসকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোন তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ‘সহায়ক’ হবে।

চীন ও বাংলাদেশ ভালো প্রতিবেশী যারা একে অপরকে ভালোভাবে জানে এবং হাজার বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছে বলে বুধবারের বৈঠকে উল্লেখ করেন শি। কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে, দুই দেশ সব সময় একে অপরকে সম্মান ও সমর্থন করে আসছে। গ্লোবাল সাউথ নামে পরিচিত বিশ্বের উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার ‘উদাহরণ’ স্থাপন করেছে চীন ও বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ও চীনের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে আগামী বছর। আসন্ন ২০২৫ কে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ কর্মসূচীর আওতায় দ্বিপাক্ষিক বন্ধনকে আরও গভীর করার সুযোগ হিসেবে দেখছে বেইজিং। এই কর্মসূচীতে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আরো সহযোগিতার হাত বাড়াতে চান চীনা প্রেসিডেন্ট শি।

শি মনে করেন, চীন একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে, একটি উন্নয়নের পথ অনুসরণ করে যা তার জাতীয় অবস্থার সাথে মানানসই, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় অবিচল থাকবে। যে কোনো বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বাংলাদেশকে সমর্থন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট।

বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে এক-চীন নীতি মেনে চলে, তাইওয়ান প্রশ্নে চীনের অবস্থানকে সমর্থন করে, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের দৃঢ় বিরোধিতা করে এবং চীনের মূল স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।

বুধবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন শেখ হাসিনা। হাসিনা বুধবার সকালে চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এবং বিকেলে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গ্রেট হল অব দ্য পিপলে বৈঠক করেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)।

লির সাথে বৈঠকে মূলত আলোচনা হয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ও স্থান পায় দুই সরকার প্রধানের বৈঠকে। বৈঠকের পর বাংলাদেশ ও চীন বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারকসহ ২১টি চুক্তি সই করে।

অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতে সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল অর্থনীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

শক্ত হবে অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক সহযোগিতা

মঙ্গলবার বেইজিংয়ে ‘বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য, ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সুযোগ’ শীর্ষক এক শীর্ষ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী চীনা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের মূল খাতগুলো বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের অবকাঠামো, জ্বালানি ও লজিস্টিক খাতে বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে এবং চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে।

সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়ান ফেং বলেন, শেখ হাসিনার এ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিশেষ করে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার উন্নয়নে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটি যোগসূত্র।

কিয়ান বলেন, দুই দেশের উন্নয়ন কৌশল আরও সমন্বিত করা হবে, এবং দুদেশের কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্যে আরও সারগর্ভ সংকেত ব্যঞ্জনা সঞ্চার করতে ভবিষ্যতে আরও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কিয়ান বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাস্তবসম্মত সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য চীনের সৎ-প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বের ধারণার অধিকতর উপলব্ধি, উন্নয়নের ফল ভাগাভাগি করার ধারণা এবং একটি দায়িত্বশীল প্রধান শক্তি হিসেবে চীনের ভাবমূর্তি অনুধাবনের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে।

চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে নয় উল্লেখ করে কিয়ান বলেন, চীন সবসময় শূন্য-ফল খেলার বিরোধিতা করে এবং পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতার পক্ষে অবস্থান নেয়।

কিয়ান বলেন, জটিল ভূ-রাজনীতির পটভূমিতে চীন বাংলাদেশের কৌশলগত পছন্দকে সম্মান করে এবং অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে তার কোনো আপত্তি নেই।

চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ কাস্টমসের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত, চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০.৩০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে এক বছরে ০.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ঢাকায় চীনা দূতাবাস বলছে, গত ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। প্রায় ৭০০ টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ৫ লাখ ৫০ হাজার কর্মসংস্থান করেছে।

সাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের গবেষণা ফেলো হু ঝিয়াং বলে, ‘শেখ হাসিনার চীন সফর দুই দেশের মধ্যে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বকে আরও উন্নত করবে।’

হু বলেন, বিগত বছরগুলোতে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে দেখেছে যে চীনের উন্নয়ন ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিশেষ করে, বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে চীনা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, বাংলাদেশে স্থানীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণে চীনের সহায়তা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের মাত্রা বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।

ভারসাম্য এবং সম্ভাবনা

মঙ্গলবার চায়নিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসাল্টেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) চতুর্দশ জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় বিষয়, যার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমানো, অর্থপূর্ণভাবে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

কিন্তু কিছু ভারতীয় মিডিয়া আউটলেট হাসিনার চীন সফরকে দুই আঞ্চলিক পরাশক্তিকে ‘খুশি রাখার জন্য’ একটি ‘ভারসাম্যমূলক’ উদ্যোগ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। স্থানীয় মিডিয়া বলছে, ‘হাসিনার ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারত এবং অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য চীনকে প্রয়োজন’। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম বেইজিং ও ঢাকার মধ্যে সহযোগিতার কথাও বলেছে।

এক মাসের মধ্যে দুইবার দিল্লি সফর এবং অল্প সময়ের মধ্যে হাসিনার বেইজিং সফর ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লি সবসময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশকে তার প্রভাব বলয়ে রাখার চেষ্টা করে। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতে দু'দিনের সফরে হাসিনা সামুদ্রিক নিরাপত্তা, মহাসাগরীয় অর্থনীতি, মহাকাশ এবং টেলিযোগাযোগ খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

হাসিনার চীন সফরের আগে (৬ জুলাই) দুই পরাশক্তির সাথে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্ধু এবং চীন উন্নয়ন সহযোগী’।

কিছু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের মতে, ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সাথে সাথে বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অর্জন করতে চায় তবে তাদের চীনের সাথে হাত মেলাতে হবে। তবে, চীনের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ঘনিষ্ঠ করতে গিয়ে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা চাপ তৈরি হয় উন্নয়নশীল দেশের উপর।

দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতা যখনই চীন সফরে যান, ভারত সবসময় বাধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন অজুহাত ব্যবহার করে। চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে প্রভাবকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ করবে বলে ‘অতিরিক্ত’ উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেছে দিল্লিকে।

সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কিয়ান ফেং মনে করেন চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন শেখ হাসিনার সফরের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।

কিয়ানের ধারণা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে না। তিনি  বলেন, ভূ-রাজনীতির জটিল পটভূমিতে, চীন বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের প্রতি সম্মান রেখে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।

এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আরো বলেন, ভারতের চাপের মুখে চীন-বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশে হিসেবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বাধীনতা এবং উন্নয়নমুখী সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে বলে মনে করেন কিয়ান।