নজিরবিহীন বিক্ষোভে সংকটে স্বৈরাচার হাসিনা: দ্য ইকোনমিস্ট

এক পুলিশকে মেরে বিক্ষুদ্ধ জনতা ঝুলিয়ে রাখে। ছবি: দ্য মিরর এশিয়া

চলতি মাসে বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শাসনামলের সবচেয়ে ‘নজিরবিহীন’ বিক্ষোভের মুখোমূখি হয়েছেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট।

সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে বিক্ষোভে সূত্রপাত হয় উল্লেখ করে হয় প্রতিবেদনে। বিক্ষোভকারিরা গত সপ্তাহে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগের) গুন্ডা বাহিনী ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং ঢাকার রাস্তার নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম (বিটিভি) হামলার শিকার হয়। সহিংসতা দেশটির ৬৪ টি জেলায় প্রায় অর্ধেক অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে ২০ জুলাই থেকে মাঠে নামে সসস্ত্র আর্মি। গুলি থেকে হত্যার অনুমতি দিয়ে কারফিউ জারি করে ক্ষমতাসীন দল। এর আগে দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা আওয়ামী লীগের প্রশাসন। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশের ১৭ কোটির বেশি মানুষ।

আন্দোলনকে দমাতে সব ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেয় বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রতিদিন সাত ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী এবং পথচারী নিহত হয়েছে। বাস্তবে সংখ্যাটা আরো বেশি। হাজারো মানুষ আহত হয়েছেন।

বাংলাদেশের মানুষ এই হত্যাকান্ডের হিসাব জানতে চায়, তবে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার ‘সঠিক হিসাব’ দেওয়ার মানসিকতা নেই। পনেরো বছর ধরে ক্ষমতা আকড়ে রাখা হাসিনার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই বিক্ষোভ।

সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীনরা ৬১ হাজারের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছে। প্রধান বিরোধী দল (বিএনপি) দেশের অবস্থা অবনতির জন্য শেখ হাসিনাকে দায় দিচ্ছে। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখে আন্দোলনদের উপর দমন-নিপীড়ন (ক্রাকডাউন) করার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পরেছে।

ছাত্র-সাধারন মানুষ পথে নামলেও শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক স্বভাবসূলভভাবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আন্দোলনের পেছনের অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন (দলীয়) প্রশাসনের প্রতি। সংকটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেশের অধিকাংশ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাস্তবতায়, তিনি নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ‘সব কিছু’ করছেন।

গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াই করা যোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারী চাকরির ৩০ শতাংশ বরাদ্ধ রাখায় দীর্ঘদিন ধরে সুযোগবঞ্চিত থাকে মেধাবী শিক্ষার্থিরা। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পুর্ব অংশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

বাস্তবতা হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উপকরন বানিয়েছে। হাসিনা বাবা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ পরিবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে হত্যাকান্ডের শিকার হন। সেই থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার মেয়ে।

বাংলাদেশের দুই পঞ্চমাংশ তরুনের কর্মসংস্থান নেই। তার মধ্যে দলীয় নেতা কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরিতে এনে প্রশাসনকে ধরে এক দশকের বেশি সময় ধরে রাখছে আওয়ামী লীগ। প্রতি বছর চার লক্ষ স্নাতক চাকরি বাজারে প্রবেশ করে, যার বিপরীতে সরকারি পদের সংখ্যা মাত্র ৩০০০।

আওয়ামী লীগ সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে প্রানহানির সংখ্যা কমতে পারতো। গত ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। তবে কোটা পদ্ধতির চেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ অনেক বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে পুলিশ সদস্য, ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি থেকে প্রতিটি চাকরির সুযোগ আওয়ামী লীগের মাধ্যমে চলে।

দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয ও রাজপথে আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্রলীগ একটি ‘খুনি সন্ত্রাসী’ বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। ক্যাম্পাসে এটি শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, এমনকি শিক্ষার্থীদের আবাসন রুম বিতরণও নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষমতার অপব্যবহারকে ঘৃণা করে আসছে সাধারন শিক্ষার্থীরা।

শেখ হাসিনার শাসনের স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে না। বিগত ১৫ বছরে তিনি বড় ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন, কিন্তু তিনি নির্বাচনে কারচুপি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার এবং আওয়ামী লীগের ব্যবসায়িক বন্ধু ও প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতির নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন।

বর্তমানে যারা শেখ হাসিনার শাসনকে সমালোচনা করে তাদেরকে ‘রাজাকার’ হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষমতাসীনরা। একাত্তর সালে পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগীরা রাজাকার নামে পরিচিত পেয়েছিলো। এটি ইঙ্গিত করে যে ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী বাস্তবতা থেকে কতটা মূর্খ মন্তব্য করেছেন।  এমনকি মিত্ররাও গোপনে স্বীকার করে যে হাসিনা ভুল করছেন। তারপরও কোনো মন্ত্রী তার কথা বলার সাহস পান না।

ক্ষমতাসীনদের অনুগামী পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাস এবং রাস্তায় পোড়ানো যানবাহন দুর্গন্ধ  তীব্র হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ হয়তো সম্ভবত 'টিকে' থাকবে। সহিংসতার রিপোর্ট বাড়বে,। কিন্তু রাজনীতিবিদদের একটি অংশ তরুণ প্রজন্মকে দূরে রাখছে দেশের সেবা করা থেকে। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার জন্য সংকটের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি বিপর্যয়কর হতে পারে।