দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যায় বাংলাদেশের ইতিহাস পালটে দেবে এই ছাত্র আন্দোলন 

দক্ষিণ কোরিয়াকে টাইগার অর্থনীতির দেশ বলা হয়। এখানকার অর্থনীতি মূলত মিশ্র অর্থনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে শক্তিধর দেশের তালিকায় এর অবস্থান ১১তম। তাছাড়া জিডিপির দিক থেকে দেশটি বিশ্বে ১৩তম স্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত।দ্বিতীয় বিশ্বে যুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খুব বেশি অগ্রগতি সাধন করতে না পারলেও ৯০ দশকের পর থেকে দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। স্থাপত্য শিল্পেও দেশটির বিশেষ অগ্রগতি চোখে পড়ে। কোরিয়ার উন্নতির পেছনের গল্প হলো ছাত্রদের আন্দোলন। 

১৯৮০ সালের মার্চ মাস। চোন্নাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। পার্কের শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত অধ্যাপক এবং ছাত্ররা ফিরতে শুরু করেছেন। এর মধ্যেই তারা রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক দেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ,  স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রবর্তন। ১৫ই মে তারিখে আনুমানিক ১ লক্ষ শিক্ষার্থী রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে সিউল স্টেশনে পদযাত্রা করে। দু’দিন পর ১৭ই মে জেনারেল চুন সংবাদপত্রের অফিস এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করেন। কয়েকশ’ ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর ২৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে গোয়াংজুর সন্তান কিম দে-জাংও ছিলেন।

১৮ ই মে শুরুতে গোয়াংজুর চোন্নাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সে সময় জেনারেল চুন দু-হোয়ান বিক্ষোভ চলমান থাকলে সহিংসতার মাধ্যমে বিক্ষোভ দমনের হুমকি দেন। পুরো দক্ষিণ কোরিয়া জুড়ে মানুষেরা সে সময় ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিল। কোরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর গোয়াংজু ছিল এর ব্যতিক্রম। তারা বিক্ষোভ চালিয়ে যায়।এটি ২৭ মে পর্যন্ত চলতে থাকে।  সরকারি হিসাবমতে, গোয়াংজু অভ্যুত্থানে মারা যায় ১৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি, ২২ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং ৪ জন পুলিশ সদস্য। কিন্তু সর্বসম্মত বেসরকারি হিসাব মতে, প্রায় ২,০০০ নাগরিক এই অভ্যুত্থানে নিহত হন। কফিনের সারিগুলো জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের স্মরণে ১৮ই মে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গোয়াংজু গণহত্যায় নিহতদের গণকবরকে পরবর্তীকালে জাতীয় গোরস্থানে পরিণত করা হয়।

এশিয়ার দেশে দেশে গোয়াংজু ঢেউ:

১৯৮০ সালের বসন্তে দশ দিনব্যাপী সংঘটিত গোয়াংজু অভ্যুত্থান শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের লড়াইকেই উৎসাহিত করেনি। সারা পূর্ব এশিয়া জুড়ে আশি ও নব্বইয়ের দশকব্যাপী দেশে দেশে স্বৈরশাসক এবং সামরিক একনায়কদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ে পথ দেখিয়েছিল এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।

গোয়াংজু অভ্যুত্থানের ছয় বছর পর ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনে ইমেলদো মার্কোসের স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছিল।
১৯৮৭ সালে তাইওয়ানে সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে।

১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে বার্মার রেঙ্গুনে ছাত্র এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষেরা রাজপথে নেমে আসে। আন্দোলনে ভয়াবহ নিপীড়ন চালিয়ে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নি উইন ২৬ বছর পর ক্ষমতাচ্যুত হন। পরের বছরে চীনের ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবিতে একটি বিশাল ছাত্রসমাবেশ করে। তিয়ানানমেন স্কয়ারে সেদিন তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা বিশ্ববাসী আজো অবাক বিস্ময়ে স্মরণ করে।

১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া সাত সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনে নেপালের তৎকালীন রাজা রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

১৯৯২ সালের মে মাসে থাইল্যান্ডের রাজপথের গণআন্দোলনে সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কয়েক ডজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। এই নৃশংসতার জন্য জেনারেল সুচিন্দা ক্রাপায়ুনকে শাসন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

১৯৯৮ সালের ইন্দোনেশিয়ায় ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেয়। সে সময় স্বৈরশাসক সুহার্তোকে তারা ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হয়।

২০২৪ সালের  জুলাইয়ে শেখ হাসিনাকেও চ্যালেঞ্জ করে  গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেয়।সে আন্দোলন এখনো চলছে। এভাবে গোয়াংজু এবং তিয়ানমেন সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও পূর্ব এশিয়া এবং বিশ্বব্যাপী আরো বহু গণআন্দোলনের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। এ অঞ্চলকে স্থায়ীভাবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের লড়াইয়ে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন, মানবিক ও জনবান্ধব সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণের লড়াইয়ে গোয়াংজু অভ্যুত্থান একটি স্মারক হয়ে আছে। একইভাবে বাংলাদেশের এই ছাত্র আন্দোলন নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে আরেক স্মারক হয়ে থাকবে।