গণতন্ত্রের পক্ষে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ছে বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'স্বৈরাচারী'  হবার স্বপ্নে বিক্ষোভকারীদের উপর নৃশংস দমন-পীড়ন করছেন, তার প্রতিরোধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তরুন প্রজন্ম প্রতিরোধ গড়ে তুলছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গবেষনা-ভিত্তিক নিবন্ধে।

অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘থ্রিসিক্সটি ইনফো’ উদ্যোগের আওতায় ডক্টর মোবাশ্বার হাসান লেখাটি বুধবার প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া।

নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মোবাশ্বার লিখেছেন, “বাংলাদেশের বর্তমান সংকটকে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গঠনের লড়াই হিসেবে দেখা যেতে পারে। প্রায় ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর ধরে কোন ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন করেননি। তিনি বাংলাদেশকে স্বৈরাচার থেকে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে নিয়ে যেতে চান বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশের হাসিনার ‘সর্বগ্রাসী’ দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও তাকে এবং তার সরকারকে কোন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না এক দশকের বেশি সময় ধরে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের মৃত্যু, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং কারাবরণ সহ দমন-পীড়নের মুখোমুখি হতে হয়।

বর্তমানে যে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের এবং বিরোধী মতাদর্শের মানুষদের নিপীড়ন করা হচ্ছে, তা বৈধ করতে যে কাউকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ এবং ‘ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে সহজ ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছেন হাসিনা। হাসিনা বিশ্বাস করেন, তার বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষগুলো প্রয়াত বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ স্বপ্নকে ‘লাইনচ্যুত’ করতে চায়।

হাসিনার সহজ রাজনৈতিক ব্যাখ্যার বিপরীতে যে বিক্ষোভ হচ্ছে, সেখানে কয়েক হাজার বাংলাদেশী ছাত্র এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ‘জবাবদিহিমূলক সরকার’ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠির (মেজরিটি) অংশগ্রহণ চায়। তারা প্রশাসনের চাকরিতে ন্যায্য প্রবেশাধিকারের দাবি করে আসছে কয়েক বছর ধরে।

গত পনেরো বছর ধরে সর্বস্তরের বাংলাদেশিরা ‘স্বৈরাচারী’ শাসনের মুখে তাদের সহনশীলতা দেখিয়েছে। এবছরে এসে শাসন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে তরুন ছাত্র বিক্ষোভকারিরা।

হাসিনার ‘সর্বগ্রাসী স্বৈরাচারী’ শাসনের বিরুদ্ধে বর্তমান ছাত্রদের প্রতিরোধ (পুশব্যাক) দেশটিতে গণতন্ত্র ফেরাতে একটি 'ব্রিকোলেজ' (বহুমূখী আন্দোলনের) একটি উদাহরণ তৈরি করেছে। যেখানে ‘অংশগ্রহণমূলক’ আদর্শকে সমুন্নত করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে জনগণ।

এর আগে, ২০১৮ সালে কয়েক দফা বিক্ষোভে, শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের নাতি নাতনীদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ সরকারি চাকরির কোটা বাতিলের দাবি করেছিল।

তরুন শিক্ষার্থীদের যুক্তি হলো, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা তাদের জন্য সম্মানজনক ছিলো, কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এবং গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসিনা শুধু ‘দলীয় ক্যাডার’ নিয়োগের জন্য কোটা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে।

ছয় বছর পরে ‘কোটা’ আন্দোলন আবারো সামনে এলো। যারা সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করতে শুরু করেছিল শিক্ষার্থীরা। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে যে তারা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এবং প্রতিবাদ করার অধিকার আছে তাদের।

এক পর্জায়ে হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলো তাদেরকে ‘রাজাকার’ বলা হয়। এটা বাংলাদেশের একটি অবমাননাকর শব্দ। সরকার প্রধানের কাছ থেকে এমন মন্তব্য বিক্ষোভকারীদের আরো বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

আন্দোলনকারীরা হাসিনাকে ‘স্বৈরাচারী’ বলে স্লোগান দেয়। বিক্ষোভ দমন করার জন্য, হাসিনা প্রথমে তার অনুগামী ছাত্রলীগকে মোতায়েন করে। বন্দুক, অস্ত্র ও লাঠি নিয়ে মাঠে নামে ছাত্রলীগ। তাদের নির্বিচারে, হিংসাত্মক আক্রমণে মেয়ে আন্দোলনকারীরাও রক্ষা পায়নি। অনেক ক্ষেত্রে, পুলিশকে ছাত্রলীগকে সহযোগিতা করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের দখল নিতে শারীরিক শক্তিও প্রয়োগ করছে ছাত্রলীগ।

শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এক পর্যায়ে সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রূপ নেয়। তারা হাসিনার মুখপত্র হিসেবে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে আগুন দিয়েছে বলে অভিযোগ এনেছে ক্ষমতাসীনরা।

হাসিনা ছাত্র বিক্ষোভ দমন করতে সমস্ত নিরাপত্তা বাহিনী - পুলিশ, সামরিক, সীমান্তরক্ষী, গোয়েন্দা শাখা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে মোতায়েন করেছিলেন। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট থেকে শুরু করে ‘কঠোর কারফিউ’ জারি করা হয়েছিল। বিক্ষোভকারিদের দমনে 'শুট অন-সাইট' নির্দেশনা আছে হাসিনার প্রশাসনের কাছ থেকে। ফলাফলটা অনেক ভয়ানক ছিলো। মিডিয়ার বিরুদ্ধেও ক্রাকডাউন চালানো হয়। নিয়ন্ত্রিত সরকারি বেসরকারি মিডিয়ায় নিহতের খবর আসে সর্বোচ্চ ২০০ জনের। সংখ্যাটা আরো বেশি হতে পারে। তাদের অধিকাংশ ছাত্র, নিহতদের মধ্যে কিছু শিশু ছিল।

আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয় ঢাকায়। দেশিও এলিট ফোর্স র‍্যাবের হেলিকপ্টারের পাশাপাশি জাতিসংঘের ‘ইনসাইনিয়া’ দেয়া কপ্টারও ব্যবহার করা হয় বাংলাদেশের গণ-আন্দোলন নিয়ন্ত্রনে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা দেশের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী, যাদের দেশের সীমান্ত রক্ষা করার কথা, তাদের নিজেদের নাগরিকদের ওপর গুলি চালাতে দেখা গেছে, যা শুধুমাত্র ‘স্বৈরাচার’ শাসকদের পক্ষেই সম্ভব।

আন্দোলনের চাপের মুখে ‘টেলিফোনে নিয়ন্ত্রিত আদালতে’র মাধ্যমে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশে নামিয়েছে ‘স্বাধীনতার চেতনা’কে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শেখ হাসিনা। জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধী বা হিজড়া হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের জন্য ২ শতাংশ কোটা রাখার সিদ্ধান্ত আসে আওয়ামী লীগের আদালত থেকে।

কোটা আন্দোলন থেকে গণ আন্দোলনে রূপ নেয়া বিক্ষোভ দমাতে পারেনি এই রায়। পাশাপাশি সমালোচনাকারী, মিডিয়ার কর্মীদের গ্রেফতারে রাতের আধারে অভিযান (ক্রাকডাউন) চালানো হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকার পরে ইন্টারনেট স্বাভাবিক হবার সাথে সাথে আওয়ামী প্রশাসন ও ছাত্রলীগের নৃশংস হামলায় নিরপরাধ ছাত্র, শিশু ও সাধারণ মানুষকে হত্যাকান্ডের ভিডিও এবং ফটোগুলি সামনে আসতে থাকে। নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষকে গুলি করে রাস্তায় ফেলে যেতে দেখা যায়। অনেকেই হারিয়েছেন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি চোখও।

আন্দোলনরত কয়েকজন ছাত্রনেতাকে জোরপূর্বক গুম করা হয়, নির্যাতন করা হয় এবং সরকারের সাথে আপস করতে বাধ্য করা হয়। যাইহোক, হাসিনা যখন আপাতদৃষ্টিতে রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছেন, তবে মানুষের মন জয় করতে পারবেন না।

যে ছাত্রনেতাদের জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা হাল ছাড়ছে না। ভাঙ্গা কণ্ঠ, অশ্রুসজল চোখ এবং স্পষ্ট যন্ত্রণায়, তারা একটি সংবাদ সম্মেলন করে এবং শেখ হাসিনার কাছে ছাত্রদের গণহত্যার দায় স্বীকার এবং তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান। এটাই সম্ভবত হাসিনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ বহুদিন তিনি জবাবদিহিতার বাইরে ছিলেন।

যে কোনও স্বৈরাচার নেতার মতো, তিনি নিজেকে রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচনা করেন, কারও কাছে জবাবদিহি করেন না, শেখ হাসিনাকে তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দায় স্বীকার করতে বলা হচ্ছে। নির্যাতিত ভিক্টিম শিক্ষার্থীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারে আন্দোলন করেছে।