দিল্লি ও শেখ হাসিনার তৎপরতা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলো যেসব কারণে

গণহত্যা চালিয়েও রক্ষা হলো না, শেখ হাসিনা অবশেষ গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বর্তমানে দিল্লির হিন্দন বিমান ঘাঁটির কাছে একটি সেফ হাউজে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে আছেন। এ কয়েক দিনে তার সঙ্গে দেখা করেছেন ভারতের বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যদিও দিল্লিতে পালিয়ে আসা আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। 

কীভাবে ৫ আগস্ট তিনি পালিয়ে যান, তা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা বিশ্লেষণ চলছে। কিন্তু এখনো অন্তরালে থেকে গেছে অনেক ঘটনা। সার্বিক বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে দ্য মিরর এশিয়া। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখ হাসিনা যে ৫ আগস্ট পালিয়ে আসবেন তা জানতেন ভারতের গোপন গোয়েন্দা বিভাগের কিছু কর্মকর্তা। এ ছাড়া রাজনীতিবিদ, আমলা, সাংবাদিক কারো কাছে কোনো খবর ছিল না। যদিও শনিবারই (৩ আগস্ট) ভারতের সঙ্গে হাসিনার এ বিষয়ে (পদত্যাগ ও পালানো) আলাপ হয়ে যায়। আলাপের শুরুতে শেখ হাসিনা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ‘মার্চ টু ঢাকা’ বা যে কোনো কর্মসূচি ঠেকিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে এ বলে আশ্বস্ত করেন যে, তার পুলিশ গত ১৫ বছরে বিএনপির অসংখ্য কর্মসূচি ঠেকিয়ে দিয়েছে। 

কিন্তু ভারতের কাছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কিছু তথ্য ছিল। এমনকি আন্দোলনকারী অনেক সমন্বয়ক সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় ক্যান্টনমেন্টে আছেন বলেও শেখ হাসিনাকে জানানো হয়। বলা হয়, সেখান থেকে তারা ভিডিও বার্তা দিচ্ছে। এ ছাড়া একটি পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আন্দোলনের মাঠ পরিবর্তন করে ফেলতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

এতে শেখ হাসিনা কিছুটা আতঙ্কিত হলেও ভারতের কাছ থেকে প্রথম দফা আন্দোলন দমানোর মতো দ্বিতীয় দফা দমনেও সহযোগিতা চান। কিন্তু শনিবার-রবিবার ভারতে ছুটির দিন জানিয়ে সে ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। যদিও প্রথম দফার আন্দোলনে (১৬-১৯ জুলাই) শনিবারও একাধিক বৈঠক করে র এর একটি দল পাঠিয়েছিল ভারত।

ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র বলছে, প্রথম দফা আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও তারা বেশ স্বস্তিতে ছিলেন। ১০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার, ২৫ হাজার আহত ও ৪০০ মত মানুষকে হত্যার পর বিদেশিদের বিফ্রিং ও সমন্বয়কারীদের উঠিয়ে নিয়ে পরিস্থিতি শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে ধারণা করেন তারা।

এমনকি দেশের নানা জায়গায় সমন্বয়কদের একাংশদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণার আয়োজন করে ডিবি পুলিশ। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছয় সমন্বয়কের ভিডিও বার্তা ছড়ানো হয়। এতেও আন্দোলন দমে যায়নি। বরং সারা দেশে ‘স্পষ্ট বিবৃতি’ দিয়ে শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেন। সমন্বয়কদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতী হিতে বিপরীত হওয়ায় শেখ হাসিনা ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদকে ‘অথর্ব’ বলে গালি দেন। 

এদিকে দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই সেনাবাহিনীর বর্তমান ও সাবেক অফিসারদের একাংশ শেখ হাসিনার ওপর অসন্তুষ্টির বিষয়টি সেনাবাহিনী প্রধানকে জানিয়ে দেন। ছাত্রদের ওপর আর গুলি চললে তারা মাঠে নামার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে আন্দোলন দমাতে শান্তিরক্ষা মিশনের যান ব্যবহারের কারণে সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তাদের অনেকে শান্তি মিশন থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এ ছাড়া সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে দ্যা মিরর এশিয়ার প্রতিবেদন “যেভাবে ‘র’ শেখ হাসিনার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে এগিয়ে এলো’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিভিন্ন জায়গায় মিলিত হয়ে সেনা কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেন। তার বলেন ‌‘র’ এভাবে দেশের ভেতরে প্রবেশ করে অপারেশন করলে দেশের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকে না। এ সময় অনেকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার আরেকটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশে সক্রিয় একটি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তাদের নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান হতো। কিন্তু এ আন্দোলনে সেটা হয়নি। ফলে গোয়েন্দা সংস্থাটি দ্বিতীয় দফা আন্দোলনে যে প্রভাব খাটাতে শুরু করে তা নিয়ে ‘র’ খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিল না। 

জানা যায়, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাটি ২ আগস্ট সেনাবাহিনীর সাবেক কিছু কর্মকর্তা, দেশের প্রভাবশালী নাগরিক সমাজ, শিল্পী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্যদের ৩ আগস্ট শনিবার শহীদ মিনারের কর্মসূচি সফল করতে পরোক্ষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। 

এদিকে ৩ আগস্ট শনিবার যখন শহীদ মিনারের এক দফার দাবি জানানো হচ্ছে, তখন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাকে শেখ হাসিনা তার প্ল্যান এ, বি ও সি জানান। ‘এ’ ছিল রবিবার থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা অস্ত্র হাতে মাঠে থাকবে এবং আন্দোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। লাশের সংখ্যা গোপন করতে গণমাধ্যমকে চাপে রাখা হবে। জানা যায় ৪০০০ প্রশিক্ষিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগকে রবিবার অস্ত্র দিয়ে মাঠে নামানো হয়। 

প্ল্যান ‘বি’ ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন। তিনি গোপালগঞ্জে নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তা চাইবেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা-হামলা না হওয়ার নিশ্চয়তা চাইবেন। প্ল্যান ‘সি’ হচ্ছে, তিনি ত্রিপুরার আগরতলায় চলে আসবেন। সেখানে ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে গ্রহণ করবেন। এই তিন প্ল্যান সম্পর্কে জানতেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জয় ও পুতুল। কিন্তু ভারত লবির কিছু আওয়ামী লীগ নেতাও বিষয়টা আঁচ করতে পারেন ফলে তারা শনিবার থেকেই দেশ ছাড়া শুরু করেন। এ খবর তিন বাহিনীর প্রধানের মধ্যেও জানাজানি হয়। ফলে শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে পদত্যাগ করতে না চাওয়ার ভনিতা তিন বাহিনীর প্রধানের কাছে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। তারাও শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হননি।

আরেকটি গোয়েন্দা সূত্র দ্যা মিরর এশিয়াকে বলছে, রবিবার ৪ আগস্ট সারা দেশে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে. তার বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতাদের গুলিতে হয়েছে। কারণ শেখ হাসিনার তিনটি পরিকল্পনার তথ্য কিছু ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের কাছেও রবিবারই চলে যায় এবং তারাও আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েন। যে কারণে পুলিশও রবিবার থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।