জয়ের বক্তব্য নিয়ে যা বললেন আলী রীয়াজ

আলী রীয়াজ।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা ও দলটির ভবিষ্যৎসহ বিভিন্ন বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া দিয়ে যাচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। হাসিনা পুত্রের বক্তব্যগুলো নিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো আলী রীয়াজ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা আলী রীয়াজের বক্তব্য দ্য মিরর এশিয়ার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

গণঅভ্যুথানের মুখে পলাতক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ৫ আগস্ট থেকে যেসব কথাবার্তা বলছেন সেগুলোকে কেবলমাত্র একটা বড় ধরনের ধাক্কা’র প্রতিক্রিয়া কিংবা কী বলবেন, কী করবেন সেই বিষয়ে অস্থিরতার প্রকাশ বলে মনে করার কারণ নেই। এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করাও সঠিক প্রতিক্রিয়া নয়। এই বক্তব্যগুলোর ধারাক্রম অনুসরণ করলেই বোঝা যাবে আসলে কী ঘটছে, কেন ঘটছে। এই কথাগুলো দেশের ভেতরে ঘটনা প্রবাহকে যে দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা হচ্ছে তার ইঙ্গিত। কিন্ত এই বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা অবহিত এবং তা প্রতিরোধে কতটা সক্রিয় সেটা স্পষ্ট নয়।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাবার পর এক ভিডিও বার্তায় স্বৈরশাসক হাসিনার পুত্র জয় বলেছিলেন ‘শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, সেটা আমারও চিন্তার বিষয় না, আমার পরিবারেরও বিষয় না। আপনারা বুঝবেন’।

দেশ, জনগণ, এমনকি তাঁর দলের নেতাদের প্রতি তাঁদের দায়িত্বের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা এবং ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছিল এই বক্তব্যে; তা ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিন্ত পরদিন থেকেই তাঁর অবস্থানের বদল লক্ষ্য করা যায়। ৬ আগস্ট বিবিসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হাসিনা’র পুত্র বলেন, শেখ হাসিনা রাজনীতিতে ফিরবেন না। “আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি – আমাদের যথেষ্ট হয়েছে।”

রাজনীতিতে হাসিনার ফিরে আসা না আসা সম্ভবত সেই পর্যন্ত পারিবারিক সিদ্ধান্তের আওতায় ছিল। তারপর থেকে তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম বদলে যায়।

৭ আগস্ট তিনি বলেন, ‘আপনারা সাহস নিয়ে দাঁড়ান, আপনারা একা না। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। বঙ্গবন্ধুর পরিবার কোথাও যায়নি। নেতা-কর্মী ও আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য যা করা প্রয়োজন আমরা করতে প্রস্তুত’।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে বিলম্ব, পুলিশের অনুপস্থিতি, বিশৃঙ্খলা, সংখ্যালঘুদের ওপরে  হামলা এবং ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় কথিত ডাকাতির ঘটনার প্রেক্ষাপটে সজীব ওয়াজেদের এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই অবস্থার সুযোগ নেয়ার এবং অস্থিতিশীলতা তৈরির প্রচেষ্টার সূচনা হয়েছে। একই সময়ে ভারতের গণমাধ্যমে প্রচারিত খবর, সেখানকার নীতি-নির্ধারকদের বক্তব্য, সামাজিক মাধ্যমে এই আন্দোলনের জন্যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার প্রোপাগান্ডা জোরদার হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, ভারতের কথিত বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞরা বারবার একই সুর তুলতে থাকেন।

দেশের ভেতরে সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে ফেলা প্রশাসনিক কাঠামোকে দাঁড় করানো সম্ভব হয় না কেবল এই কারণে নয় যে, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, বরঞ্চ এই কারণে যে এগুলোর ভেতরে আওয়ামী লীগের লোকজন চাইছিল না যে, পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটুক। ইতিমধ্যে সরকার গঠন হয় এবং তিনি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন যে, তিনি রাজনীতিতে আসতে প্রস্তুত।

শুক্রবার ৯ আগস্ট তিনি রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তাঁর মা পদত্যাগ করেননি, ফলে সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, এই সাক্ষাৎকারে তিনি এও বলেছেন যে, এই বিষয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তাঁর এই বক্তব্য অন্তর্বর্তী শর্করারে বৈধতাকে খোলামেলাভাবে চ্যালেঞ্জ। আদালতের উল্লেখ সকলের মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত বাংলাদেশের উচ্চ আদালত যে হাসিনার হাতে গড়া এবং তাঁর পুতুলদের দিয়ে তৈরি সেটা সকলেই জানেন। তদুপরি আদালতকে শিখণ্ডী দাঁড় করিয়ে এজেন্ডা বাস্তবায়নের ইতিহাস কারো ভুলে যাবার কারণ নেই।

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল থেকে শুরু করে শেষ কোটা সংস্কার বাতিল – সব বিষয়েই আদালত দেখানোর ঘটনা আছে। দ্বিতীয়ত এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের আইনজীবী এবং সমর্থকদের প্রতি নির্দেশ কী করতে হবে। একই সময়ে আমরা জানতে পারি যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ওপর নজর রাখতে কমিটি করেছে। আপাতদৃষ্টে তা সীমান্ত সংশ্লিষ্ট হলেও এর ভেতরে যে বার্তা তা কেবল সীমান্ত রক্ষা বিষয়ক নয়।

আদালত বিষয়ে জোড় এই বক্তব্যের পর শনিবার অকস্মাৎ সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্টের সভা ডাকা অশনি সংকেত। মনে রাখা দরকার যে, কেবল যে আদালতই সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের নিয়োগকৃতদের নিয়ন্ত্রণে আছে তা নয়। রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিনকে শেখ হাসিনা একক ভাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাঁর আনুগত্য নিয়ে সংশয় থাকাই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রধান ওয়াকারউজ্জামানসহ সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার কারণ আছে। যেমন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে আলোচিত সংস্থা ডিজিএফআই’র ব্যাপারে কোনও ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেনাবাহিনীর যে সব অফিসারকে ইতিমধ্যেই বরখাস্ত করা হয়েছে তাঁদের বরখাস্তের কারণ যদি অতীতে তাঁদের ভূমিকাই হয় তবে তাঁদের বিচারাধীন করার কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। এর বাইরে পুলিশের সভায় গোলযোগ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

সাধারণ নাগরিকদের ভেতরে আশাবাদ এবং উদ্বেগ-আশঙ্কা উভয়ই আছে। কিন্ত এইসব ঘটনা এবং পলাতক স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার উপদেষ্টার এই সব কথাবার্তার ধারাবাহিকতা অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতাকে প্রশ্ন করে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টারই লক্ষণ।