সরকারকে বিপাকে ফেলতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বিএডিসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা

কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

৫ আগস্টের পর দেশের পটপরিবর্তন হলেও তাদের পদ-পদবি কিংবা চেয়ারে কোনো পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু তারা বিভিন্নভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অসহযোগিতার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ নিয়ে এতদিন ধরে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, বিএডিসি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বিএডিসি কৃষিবিদ সমিতি ও বিএডিসি প্রকৌশলী সমিতির কতিপয় দুর্নীতিবাজ নেতারা এখনও গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। আসন্ন রবি মৌসুমে বীজ ও সার সরবরাহ এবং সেচ সুবিধা কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে এইসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে তারা বেশ কয়েকবার গোপনে সভা করেছে বলেও একটি সূত্র দ্য মিরর এশিয়াকে নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী দলীয় এসব কর্মকর্তারা গত ১১ আগস্ট কৃষি ভবনে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন প্রধান প্রকৌশলী (সওকা) শিবেন্দ্র নারায়ণ গোপ, মহাব্যবস্থাপক (পাট বীজ) দেবদাস সাহা, আলু বীজ বিভাগ (অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক) আবুল খায়ের মো. নুরুল ইসলাম প্রমুখ। বৈঠকে বিএডিসির বেশ কিছু কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা সবাই বিগত হাসিনা সরকারের আমলে বিএডিসিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কৃষি ভবনকে আওয়ামী লীগের দলীয় অফিসে রূপান্তর করে। এই সব কতিপয় নেতারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও চেয়ারম্যানকে তাদের পক্ষে ষড়যন্ত্র করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। এর ফলে বিএডিসির সচেতন ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের জোরালো প্রতিবাদের মুখে তা ভেস্তে যায়।

এ নিয়ে বিএডিসি’র মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতেও উত্তেজনা ও অস্থিরতা চলছে। আওয়ামী সরকারের আমলে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি ও লোপাটকারী কতিপয় নেতা নামধারী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে না দিলে আসন্ন রবি মৌসুমে বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু, ডাল তৈলসহ অন্যান্য বীজ সরবরাহ; টিএসপি, এমওপি ও ডিএসপি সার সরবরাহ এবং সেচ সুবিধা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএডিসি’র একাধিক কর্মকর্তা জানান, আলু বীজ বিভাগ (অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক) আবুল খায়ের মো. নুরুল ইসলাম একজন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা। বাইরে সজ্জন সেজে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত একজন অফিসার তিনি। সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও সাবেক কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের হয়ে বিএডিসির বীজ বিভাগের প্রকল্প ও মাঠ পর্যায়ের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে ছিলেন।

নুরুল ইসলাম ডাল ও তৈলবীজ প্রকল্পের পিডি থাকাকালে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। যোগ্য কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে তিনি তার মতো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দিয়ে মাঠ প্রশাসন সাজিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লুটপাট করে আসছেন। বিএডিসিতে তার আশ্রয়দাতা ছিলেন  তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক প্রদীপ কুমার  দে। যাকে সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব সাজ্জাদুল হাসানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিএনডিসিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন প্রদীপ কুমার। তিনি ধান, গম, ভুট্টা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, এজিএম বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ বিভাগ এবং মহাব্যবস্থাপক (বীজ) থাকাকালে শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে জাতীয় নিরীক্ষা বিভাগের অডিট আপত্তি রয়েছে।

জানা গেছে, প্রদীপ কুমার সংস্থার বীজ উইংয়ের বিভিন্ন বিভাগে তারমতো দুর্নীতিবাজ অযোগ্য কর্মকর্তাদের বসান। তিনি চলে যাওয়ার পর সে দায়িত্ব নেন নুরুল ইসলাম। নুরুল ইসলাম ডাল তেল প্রকল্প শেষ হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব সাজ্জাদুল হাসান ও কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারকে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বিএডিসির চেয়ারম্যানকে বাধ্য করে বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ বিভাগে পোস্টিং নেন এবং যথারীতি দুর্নীতি শুরু করেন।

নুরুল ইসলামের রিয়েল এস্টেটের বিজনেস রয়েছে। কোটি কোটি টাকা দিয়ে উত্তরায় বাড়ি কিনেছেন। বর্তমানে তিনি বনানীর ৪ রোডের বাড়ি ১৮, ব্লক জি. ফ্ল্যাট৩/১ বিলাসী ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। এই ফ্ল্যাটটি আড়াই কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন। এ ছাড়া আমেরিকায়ও বাড়ি কিনেছেন। বর্তমানে তার ছেলে মেয়ে আমেরিকা পড়া শোনা করছে। নুরুল ইসলাম যে কোনো সময় দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দেবেন বলে শোনা যাচ্ছে। বগুড়ায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে সে এখন নব্য বিএনপি সাজারও চেষ্টা করছে।

এদিকে সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সিনিয়র সহকারী পরিচালক হয়েও উপপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন ড. রহমত আরা। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

বিএডিসির আরেক শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হচ্ছেন মিজানুর রহমান। আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে যাকে সবাই বিএডিসির মাফিয়া পিডি হিসেবে চিনেন। তিনি সাবেক কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। ড. রাজ্জাককে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে দিয়েছেন এই মিজান। যে কারণে সাবেক কৃষিমন্ত্রী তার পকেটের লোক বলে বেড়াতেন। কৃষি সচিব ও বিএডিসির চেয়ারম্যানরাও তাকে সমীহ করতেন। মিজান বিএডিসির নতুন কোনো প্রকল্প পাশ হলেই মন্ত্রীর সাথে যোগসাজশ করে ওই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগের কন্টাক্ট নিয়ে নিতেন। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে ৩-৫ কোটি টাকা কন্টাক্ট হতো।

পিডি হওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি হিসেবে নিয়োগ পান মিজানুর রহমান। মিজান ৩৬৫ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প থেকে অবৈধভাবে  শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রীর পাশাপাশি সচিব ও চেয়ারম্যানদের বিভিন্ন ভাবে খুশি করেছেন। শুধু তাই নয় বিএডিসির আট সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মিজানুর রহমানকে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে পদোন্নতি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

মিজানের ঢাকার বেইলি রোড ও লালমাটিয়ায় বিলাসবহুল ফ্লাট, পূর্বাচল, বসুন্ধরা ও উত্তরায় একাধিক প্লট রয়েছে। জামালপুরে বিপুল পরিমাণ জমি এবং কানাডায় বাড়ি রয়েছে। দেশের স্বার্থে তার সম্পদের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে বিএডিসি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনে করেন।

দেবদাস সাহা আরেকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার নাম। তিনি ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই টাকার বিনিময়ে দুর্নীতি করা যায় এমন জায়গায় পোস্টিং নেন। তৎকালীন কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সহায়তায় টাকার পাহাড় বানান। সে এখনও বিএডিসিতে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির করে বর্তমান সরকারকে বিপাকে ফেলানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত।

বিএডিসি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দাবি, এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দ্রুত সম্পদের তদন্ত এবং সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক।

বিগত ১৮ জুলাই ২০২২ তারিখে এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদে আটজনকে ডিঙিয়ে প্রকৌশল উইং এর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং কৃষি পুলের যুগ্ম পরিচালক রিপন কুমার মন্ডলকে নয়জনকে ডিঙিয়ে অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতিসহ বদলি বাণিজ্য ও বিএডিসি’র বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তুলে ধরা হয়। তবে সে সময় সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি বিএডিসি’র চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে মোবাইলে জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন আলু বীজ বিভাগ (অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক) আবুল খায়ের মো. নুরুল ইসলাম। পরে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, আপনার সঙ্গে তো আমার পরিচয় নেই। আপনি আগামীকাল আমার অফিসে আসেন। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলব।