শেখ হাসিনার প্রশ্রয় পেয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আনভীর

শেখ হাসিনার প্রশ্রয় পেয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আনভীর

কলেজছাত্রী মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলা থেকে সায়েম সোবহান আনভীরকে বাঁচাতে খোদ আওয়ামী লীগ সরকার সংশ্লিষ্টরা মাঠে নেমেছিল বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদি নুসরাত জাহান তানিয়া।

মুনিয়ার মৃত্যুর তিন বছর পর মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন মুনিয়ার বোন তানিয়া।

কয়েক কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে মোসারাত জাহান মুনিয়া হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রভাবিত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তার দাবি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্রয় পেয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আনভীর। যার কারণে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।

তানিয়া বলেন, “আমি বিশ্বাস করি শেখ হাসিনার প্রশ্রয় না পেলে আনভীররা এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পেত না। পিবিআইতে যখন মামলাটি গেল সেখানেও অর্থ ঢেলে তৎকালীন প্রধান বনজ কুমারকে ঘুষ দিয়ে একটি একপেশে তদন্ত রিপোর্ট বের করে বসুন্ধরা গ্রুপ। ওই রিপোর্টেও আনভীরসহ সবাইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

“আমি নারাজি জানানোর পর সেটাও আদালতে খারিজ হয়ে যায়। এভাবে মুনিয়া হত্যা ও ধর্ষণ মামলাটিকে নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট ও আদালতের রায় আওয়ামী আমলের বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই একটি নির্লজ্জ উদাহরণ।”

২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকার গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন রাতেই বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেন তানিয়া।

মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর ওই ফ্ল্যাট থেকে তার মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। যেখানে ছয়টি ডায়রিও ছিল। এছাড়া বহুতল ভবনটির সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষার পর সেসময় পুলিশের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছিল যে, মুনিয়ার ফ্ল্যাটে আনভীরের যাতায়াতের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সেসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আনভীর ও মুনিয়ার বেশকিছু যুগল ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল।

তবে মুনিয়ার আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলা থেকে শেষ পর্যন্ত সায়েম সোবহান আনভীরকে অব্যাহতি দেয় পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দেওয়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “মুনিয়ার আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলায় বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”

এরপর ৭ সেপ্টেম্বর আনভীর ও তার পরিবারের সদস্যসহ আট জনের বিরুদ্ধে মুনিয়াকে ‘হত্যা ও ধর্ষণের’ অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়।

তদন্তের পর এই মামলা থেকেও আনভীরকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিবেদন দেয় পিবিআই।

শুরু থেকেই নুসরাত জাহান তানিয়ার অভিযোগ ছিল, কয়েক কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রভাবিত করেছেন আনভীর। সেজন্য মুনিয়া হত্যার সঠিক বিচার হয়নি।

গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে নতুন করে আবারও মুনিয়া হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিতের দাবি তোলে তার পরিবার।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে বসুন্ধরা গ্রুপ বা এর ব্যবস্থা পরিচালকের কোনও বক্তব্য সকাল সন্ধ্যা জানতে পারেনি।

এমনকি মুনিয়ার মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি সায়েম সোবহান আনভীর।

সংবাদ সম্মেলনে তানিয়া অভিযোগ করে বলেন, শুরু থেকেই আনভীরকে বাঁচাতে সক্রিয় ছিল প্রশাসন। বসুন্ধরা গ্রুপ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকেই কিনে ফেলতে চেয়েছিল বলেও অভিযোগ তার।

তানিয়া বলেন, “আমি যখন গুলশান থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম, তখন থেকেই বসুন্ধরা গ্রুপ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে কিনে ফেলতে চেয়েছিল এই হত্যা ও ধর্ষণ মামলার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তৎকালীন আইজিপি বেনজির এবং গুলশান থানার ওসি সুদীপ কুমার আসামি আনভীরকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্লজ্জ ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে গুলশান থানা আনভীরকে অব্যাহতি দিয়েই তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।”

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ন্যায়বিচার পাননি অভিযোগ করে তানিয়া বলেন, “এসব ব্যাপার জানাতে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য একাধিকবার আবেদন করি। প্রায় ২৬ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি আমাকে সাক্ষাৎ দেননি।”

মুনিয়া গর্ভবতী ছিল জানিয়ে তানিয়া বলেন, “পিবিআই তাদের তদন্তেও বলেছে। সেটা ছিল আনভীরেরই সন্তান। অথচ সেই আনভীরকে তারা ডিএনএ স্যাম্পল টেস্ট করতে বলল না। তারা মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করলেও, আনভীরকে একটিবারের জন্যও জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেপ্তার করেনি। অর্থাৎ বিচারের নামে কী রকম তামাশা হয়েছে, সেটা নিশ্চই আপনারা বুঝতে পারছেন।”

তানিয়া জানান, এত অন্যায়ের পরেও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। মামলা এখনও চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমি ন্যায়বিচার এখন প্রত্যাশা করতেই পারি। এখন প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস ও আইন উপদেষ্টা ডক্টর আসিফ নজরুলের কাছে আমি ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি।”

এসময় বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন একটি পত্রিকার সম্পাদক ও আরেকটি জাতীয় পত্রিকার কুমিল্লা প্রতিনিধির বিষয়েও অভিযোগ তোলেন তানিয়া।