দুর্নীতির বরপুত্র বিমানের সাবেক এমডি মোমেনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন

বাংলাদেশ বিমানের এযাবৎকালের সবচেয়ে মহাদুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় আমলা। রাজনৈতিক দল থেকে তত্ত্বাবধায়ক, এমন কি স্বৈরাচার এরশাদের সময়ও তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ কারণে তাকে প্রশাসনে সর্বদলীয় আমলাও বলা হয়ে থাকে।

তবে মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন তুমুল আলোচনায় আসেন বিমানের এমডি হওয়ার পর। বিমানে তিনি দুর্নীতির যে রেকর্ড গড়েছেন তা আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, এমএ মোমেন বিসিএস ৮২ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসনে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে বগুড়ায় সহকারী কমিশনার হিসেবে তার মাঠ প্রশাসনে যাত্রা শুরু। ২০১৩ সালে তিনি অবসরে যান। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মাধ্যমে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর গত ১৭ আগস্ট তাকে সচিব হিসেবে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

পরদিন ১৮ আগস্ট তাকে ২ বছরের জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়। প্রশাসন সামলাতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাকে দক্ষ ও যোগ্য বলে বিবেচনা করছে। যদিও অতীত রেকর্ড বলছে ড. মোমেন চাকরি জীবনে ছিলেন মহা দুর্নীতিবাজ, অদক্ষ ও অযোগ্য একজন আমলা। তিনি দুর্নীতি ছাড়া কোনো দপ্তরেই তার দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারেননি।

২০০৬ সালের ১৪ মার্চ তিনি বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পেষণে নিয়োগ লাভ করেন। একই পদ থেকে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন। এর আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব, রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড-ডিটিসিবি’র নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি-বিএরটিএ’র চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ছিলেন।

চাকরি জীবনে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও বিমানের এমডি থাকা অবস্থায় তিনি যে অনিয়ম করেন, সেটি এযাবৎকালের সবচেয়ে মহা অনিয়ম। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ৪ পরিচালক ও ২ মহাব্যবস্থাপককে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের মধ্য দিয়ে তিনি তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ শুরু করেন।

অভিযোগ রয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তিনি বিমানে ব্যাপক রদবদল করেছেন। সে সময় ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক ধাপে তিনি প্রায় ২৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোনো প্রকার কারণ ছাড়াই, ২৫ বছর উত্তীর্ণদের বাধ্যতামূলক অবসর ও ২৫ বছরের কম চাকরিজীবীদের ছাটাই করেন। ফলে ২৪ বছর চাকরি করেও অনেককে বিমান থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়। কারণ হিসেবে সে সময় তিনি বিমান থেকে অতিরিক্ত জনবল কমানোর কথা বললেও বাস্তবিক অর্থে সে সময় বিমানে অতিরিক্ত জনবল ছিল না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানে অনুমোদিত ৫৬০০ জনবলের বিপরীতে সে সময় জনবল ছিল ৪৫০০ জন। যার মধ্যে ২১৭৭ জনকে চাকুরিচ্যুত করে আবার তাদের মধ্য থেকে ১১০০ জনকে দৈনিক ও মাসিক চুক্তিতে নিয়োগ দেন তিনি।

এ ছাড়াও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন লোকবলও নেওয়া হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। এতে সে সময় যে জনবল প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ছিল না, সেটি স্পষ্ট হয়।

বিমানের তথ্য বলছে, ২০০৭ সালের ৩০ জুন ১৮৭৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ড. এমএ মোমেন স্বেচ্ছায় অবসরের নামে জোর করে চাকুরিচ্যুত করেন। ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিম এর নামে একটি মুদ্রিত ফরমেট তৈরি করে তিনি কর্মচারীদের পূরণ করতে বাধ্য করেন। ফরম পূরণ না করলে খালি হাতে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে সে সময় ভয় দেখানো হয় কর্মচারীদের। এভাবে ভয় দেখিয়ে তিনি মোট ২১৭৭ জনকে বিমান ছাড়া করেন। যা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নিয়মে হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে ড. এমএ মোমেন বিশ্ব ব্যাংক থেকে শতকরা ৫টাকা সুদে ২০ বছর মেয়াদে ৩০৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১৮৭৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান। অথচ ওই টাকা দিয়ে ৪টি সুপরিসর উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া সম্ভব ছিল। এ ছাড়া ৩০৪ কোটি টাকা মেয়াদ শেষে ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে, বিশাল অঙ্কের এই ভর্তুকি অকারণেই রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপানো হয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

কথিত আছে, ড. মোমেন বিশ্ব ব্যাংকের ওই ঋণ আনার পর তাকে প্রাইজ পোস্টিং দেয়। তবে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে একটি টাস্কফোর্স গঠিত হয়। পরে টাস্কফোর্স সে সময়কার সংস্থাপন সচিবকে চিঠি দিয়ে বিশ্বব্যাংকে ড. মোমেনের ওই প্রাইজ পোস্টিং বাতিল করে। পরে তাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।

এদিকে বিমানে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-অভিযোগের বিষয়টি তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে গঠিত ওই তদন্ত কমিটি ২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর ড. মোমেনের বিরুদ্ধে ৪৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে।

ওই প্রতিবেদনে বিমানের বিশাল অঙ্কের অর্থ লোপাট, অনিয়ম- অব্যবস্থাপনা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে বিমানের নতুন রুট চালুসহ ৯টি বিষয়ে বিস্তর অনিয়মে ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।