মাজারপন্থী ও ইসলামপন্থীরা মিলেই ভেঙেছে
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরেই একদল লোক মাজারে হামলা শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙতে শুরু করে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিদেশে ছাত্র জনতার বিপ্লবকে কট্টর ইসলামপন্থী হিসাবে প্রচার করতেই এ ধরনের হামলা করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এসব হামলার চিত্র তুলে ধরছে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলের স্বচ্ছ ধারণা থাকায় কোনো চক্রান্তই কাবু করতে পারছে না গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ সরকারকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সেপ্টেম্বরের শুরুতেই ‘মাজার ভাঙা’ ইস্যুটি সামনে চলে আসে। আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে দেশের মাজারকেন্দ্রিক একটি গোষ্ঠী ও ইসলামপন্থীদের একটি অংশ এই ইস্যুটি সৃষ্টি করে। এদের সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও কিছু সাধারণ মানুষও তাদের ফাঁদে পা দিলেও বড় আকারে ইসলামী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা এ কাজে জড়িত ছিল না বলে জানা গেছে।
মূলত তরিকত ফেডারেশন ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ একটি অংশ মাজার ভাঙচুরে নেতৃত্ব দিয়েছে। উল্লেখ্য বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙচুর করা হলেও তরিকত ফেডারেশনের মাইজভান্ডারির মাজারগুলোতে কোনো হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা শোনা যায়নি।
সূত্র জানায়, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা জুডিশিয়াল ক্যু, সংখ্যালঘু আন্দোলন ও আনসার বিদ্রোহকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়ার পর মাজার ভাঙা ইস্যুতে জড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করে ১৪ দল শরিক তরিকত ফেডারেশন। মাজারকেন্দ্রিক এই দলটির জন্ম ২০০৫ সালে। সেই থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিশেষ করে দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি জামায়াতসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর কঠোর সমালোচক।
রাজনৈতিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগকে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা একটি সেক্যুলার রাজনৈতিক দল হিসেবেই জানে। জামায়াতের সঙ্গে দলটির এক সময় রাজনৈতিক ঐক্য থাকলেও বেশিরভাগ হকপন্থী ইসলামী দলগুলোই প্রচণ্ডভাবে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী। বিগত নির্বাচনগুলোয় যার নেতিবাচক প্রভাব দলটি বুঝতে পারে। সে কারণে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী দলের আদলে প্রতিষ্ঠিত তরিকত ফেডারেশনকে কাছে টেনে নেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী জোটভুক্ত হওয়ায় দলটির তেমন কোনো সাংগঠনিক কাঠামো কিংবা জনসমর্থন না থাকলেও জাতীয় সংসদে দলটির একাধিক নেতা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ লাভ করে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই নানা ভাবে, নানান দিক থেকে তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করে তাদের এক সময়ের মিত্ররা। এর মধ্যে তরিকত ফেডারেশন ‘মাজার মেকানিজম’ করে বলে একটি গোয়েন্দা সূত্র দ্য মিরর এশিয়াকে জানায়।
কারণ হিসেবে ওই সূত্রটি বলছে, মাজারের প্রতি দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে এ ভূখণ্ডে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ বেশ কিছু আউলিয়ার অবদান এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তাদের কারণেই মূলত দেশের অন্যান্য মাজারও সাধারণ মানুষের সমীহ পেয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই অবস্থায় মাজারকে ঘিরে একটি গোলযোগ সৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই তার দায়ভার এ দেশের ইসলামী দলগুলোর ওপর বর্তাবে। আর বর্তমান সরকারের সঙ্গে ইসলামী দলগুলোর সুসম্পর্ক থাকার কারণে সরকারও তার দায় এড়াতে পারবে না। যে কারণে তরিকত ফেডারেশন সুকৌশলেই এটিকে ইস্যু বানায়।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের কওমী ও আলীয়াপন্থীদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রসিদ্ধ আলেম-ওলামাই কথিত মাজার বিরোধী। এসব আলেমদের বেশিরভাগই ওয়াজের ময়দানে মাজারের বিপক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়ে থাকেন। ফলে প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙার খবর চাউর হওয়ার পর পরই জামায়াতসহ মূল ধারার ইসলামী দলগুলোর দিকে অভিযোগের তীর তাক করা হয়। যদিও দেশের কোথাও কোনো ইসলামী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
এ বিষয়ে জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক নেতা দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, জামায়াত মাজারপন্থীদের আকীদার বিরোধিতা যুগ যুগ ধরেই করে আসছে এটা ঠিক। তার মানে এই না তারা নিজেরাই আইন হাতে নিয়ে মাজার উচ্ছেদে মাঠে নামবে। এটি একটি উন্মুক্ত ব্যাপার। ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়।
জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই নেতা আরো বলেন, আমরা সব সময়ই ধর্মীয় উদারতার পক্ষে। একটি গোষ্ঠী দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে। তবে সেটি কাজে আসছে না দেখে এখন মাজার কেন্দ্রিক চক্রান্ত শুরু করেছে। মূলত তারা দেশের হকপন্থী ইসলামী দলগুলোর পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিতর্কিত করতে চায়। কিন্তু জামায়াত কেন, দেশের কোনো ইসলামী দলের নেতা-কর্মীই তাদের ফাঁদে পা দেবে না।
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক আহমাদ আব্দুল কাইয়ুমও। তিনি বলেন, মাজার নিয়ে আমাদের মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু সেটি ভাঙার পক্ষে আমরা নই। যারা এই কাজটি করেছে তারা পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগেরই দোসর। ইসলামী দলগুলোকে বিতর্কিত করার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলা তাদের লক্ষ্য। কিন্তু দেশের জনগণ সব বোঝে। এখন কোনো ইস্যু সৃষ্টি করতে চাইলেই সফল হওয়া যায় না।
মাজার ভাঙার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কথা বলার জন্য তরিকত ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। দলটির সভাপতি নজিবুল বশর মাইজ ভান্ডারিসহ সব নেতাই ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন।