বসুন্ধরার বিটুমিনাস রিফাইনারির পরিণতি কি সামিটের দ্বিতীয় টার্মিলানের মতো হবে!
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এর আগে ১০ জুন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি) একটি চিঠি পাঠায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এতে বলা হয়, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে মজুত, পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে উৎপাদিত তেল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিক্রির বিষয়ে বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
তবে জ্বালানি বিভাগ সামিটের দ্বিতীয় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত মতো বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানির অনুমতি বাতিল করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায় জানায়, এখন বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানির অবৈধভাবে পাওয়া অনুমতি নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে, তদন্ত শেষে এ বিষয়ে অনুমতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এদিকে গত ৭ আগস্ট এ নিয়ে সামিট আনুষ্ঠানিকভাবে এক বিবৃতিতে জানায়, দ্বিতীয় এলএমজি টার্মিনাল স্থাপনের চুক্তি বাতিলের নোটিশ পেয়েছে তারা। তবে এই সিদ্ধান্ত তাদের কাছে ন্যায়সংগত মনে হয়নি। তারা এর বিরুদ্ধে আপিল করবে।
দেশে গ্যাস উৎপাদন কমে আসায় ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এর জন্য সমুদ্রে দুটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। এর একটি সামিটের, অন্যটি মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির। আরও দুটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণে ওই দুটি কোম্পানির সঙ্গে আলাদা দুটি চুক্তি হয়।
বসুন্ধরার ব্রান্ড অ্যান্ড মার্কেটিং চিফ অপারেটিং অফিসার এম এম জসিমউদ্দিন দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি এখন বসুন্ধরা বিটুমিনাস রিফাইনারিকে এখন দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, সরকারের সব ক্রাইটেরিয়া পূরণ করে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি নিতে এখন দুই বছর লাগবে। কারণ এখন ব্যাংক থেকে আর্থিক সংস্থার বিষয়টি জড়িত রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, একটা জ্বালানি তেলের রিফাইনারি তৈরি করা চারটিখানি কথা নয়। যে কেউ তৈরি করতে পারবে না। সেই কোম্পানির আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতা থাকতে হবে। বসুন্ধরাই প্রথম এলপিজি প্ল্যান্ট করেছে। বেসরকারিভাবে জ্বালানি তেলের রিফাইনারি প্রথম বসুন্ধরাই করছে। অন্য কোন কোম্পানি এগিয়ে আসেনি।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এখনও সরকারের অনেক শর্ত পূরণ করতে পারেনি বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (বিওবিসিএল)। কেরানিগঞ্জের প্ল্যান্ট থেকে বাইরে জ্বালানি তেল বিক্রির অভিযোগও পাওয়া গেছে বিওবিসিএলের (বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) বিরুদ্ধে। যদিও এ কোম্পানিটি উৎপাদিত পণ্য শুধুই বিপিসির কাছেই বিক্রি করতে পারবে।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহ করে একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিপিসি। বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকারকর্মীরা বলছেন, বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেলের ব্যবসাটি ছেড়ে দিলে অবশ্যই বেশি দামে এই পণ্য সাধারণ ভোক্তাদের কিনতে হবে। তারা বলছেন জ্বালানি তেল একটা কৌশলগত পণ্য। এ জন্য অবশ্যই এটা সরকারের হাতে থাকা উচিত। বেসরকারি খাতের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভালো নয়। এমন কি এরা একচেটিয়া মুনাফার প্রবণতার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে। জ্বালানি তেলের সরকারের সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের যত শর্ত
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রির যে অনুমতি জ্বালানি বিভাগ দিয়েছে, তা জানিয়ে গত ১৮ জুলাই বসুন্ধরাকে চিঠি দেয় বিপিসি। এতে চুক্তি করার আগে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত অঙ্গীকারনামা ও ৩৮৮টি ফিলিং স্টেশনের সমন্বয়ে নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থা তৈরিসহ বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে বলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত বসুন্ধরা কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়নি।
দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহ করে একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকারকর্মীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের ব্যবসা বেসরকারি খাতে দেওয়া হলে মানুষকে তা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। যেটা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে।
অনুমোদনের পত্রে ৩৭টি শর্ত বেঁধে দেয় জ্বালানি বিভাগ। সরকারি এসব শর্ত ভঙ্গ করলে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই অনুমোদন বাতিল করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়। শর্তের মধ্যে রয়েছে পরিচালনা ও তেল বিক্রি নিয়ে বিপিসির সঙ্গে চুক্তি ও নিরাপত্তা জামানত প্রদান করা, প্রথম তিন বছর উৎপাদিত জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ বিপিসির কাছে ও বাকি ৪০ শতাংশ নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থায় বিক্রি এবং পরবর্তী দুই বছর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত তেল বিপিসির বাইরে বিক্রি করার সুযোগ। তেলের দাম নির্ধারণ করবে বিপিসি। বিপিসির চাহিদা না থাকলে সংস্থাটির কাছ থেকে অনাপত্তি নিয়ে বাজারে বা বিদেশে রপ্তানি করা যাবে জ্বালানি তেল।
মন্ত্রণালয়ের শর্তে আরও বলা হয়েছে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তেল বিক্রির জন্য তিন বছরে সারা দেশে ৩৮৮টি ফিলিং স্টেশন বা পরিবেশক নিতে পারবে বসুন্ধরা। যেসব সিএনজি ও এলপিজি স্টেশনের তেল বিক্রির অনুমতি নেই, তারাও বসুন্ধরার পরিবেশক হতে পারবে। সরকারি কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার পরিবেশকেরা চুক্তি বাতিল করে বসুন্ধরার পরিবেশক হতে পারবে।
বিটুমিন উৎপাদন প্ল্যান্ট কবে অনুমতি পেল
বসুন্ধরা বিটুমিন উৎপাদনের প্ল্যান্ট স্থাপনের অনুমতি পায় ২০১৬ সালের ১৫ জুন। এরপর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি তেল বিক্রি করার অনুমতি চেয়ে ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আবেদন করে। ওই বছরের অক্টোবরে বিপিসি এ বিষয়ে নেতিবাচক মতামত পাঠায় জ্বালানি বিভাগে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনায় একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বসুন্ধরার উৎপাদিত তেল বিপিসির কাছে বিক্রির সুপারিশ করে।
২০২০ সালের জুলাইয়ে আবার আবেদন করে বসুন্ধরা। তাদের উৎপাদিত বিটুমিন সরাসরি ক্রেতার কাছে ও ডিজেল বিপিসির কাছে বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়। আর বিপিসির অনুমতি নিয়ে তারা বাজারে বিক্রি করছে ফার্নেস তেল ও ন্যাপথা।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জর পানগাওয়ে বিটুমিন উৎপাদনে দেশের প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে বসুন্ধরার প্ল্যান্ট উদ্বোধন করা হয়। এই প্ল্যান্টে অপরিশোধিত ক্রুড অয়েলের উপজাত থেকে তৈরি বিটুমিন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। দেশে বিটুমিনের মাসিক চাহিদা ৪২ হাজার টন। এই চাহিদা প্রতি বছর গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ছে। বসুন্ধরা বিটুমিন প্ল্যান্ট এককভাবে বছরে সাড়ে আট লাখ টন বিটুমিন উৎপাদন করতে পারবে।
সরকারি নথি বলছে, জ্বালানি বিভাগ থেকে তেল সরাসরি বাজারে বিক্রির অনুমতি না পেয়ে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরীর কাছে আবেদন করে বসুন্ধরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের জুনে আবার বিপিসির মতামত চায় জ্বালানি বিভাগ। এবার বেসরকারি খাতে সীমিত পরিসরে আমদানি ও বিপণনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে বলে মতামত দেয় বিপিসি।
এরপর এ–সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি নিয়ে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করে বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগ। গত বছরের ১১ জুন বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল বিক্রির নীতিমালার প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়। ওই বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি চেয়ে আবার আবেদন করে বসুন্ধরা অয়েল।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে প্রায় ৭০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে ১৫ লাখ টন পরিশোধন করে সরকারি কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বাকিটা পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করা হয়।
প্রতিবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে চাহিদা ৮০ লাখ টন ছাড়াতে পারে। অপরিশোধিত তেল আমদানি করে দেশে পরিশোধন করলে খরচ কম পড়ে। তাই ৩০ লাখ টন পরিশোধন সক্ষমতার কারখানা করতে ইআরএল-২ নামে প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য এক যুগেও তা সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।