সামাজিক মাধ্যমে সাইবার অপরাধের ক্রমবর্ধমান হুমকিতে বাংলাদেশ
প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ প্রত্যেককে জ্ঞানের এক অভূতপূর্ব জগতে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে এটি ইতিবাচকতার পাশাপাশি নেটওয়ার্কভিত্তিক অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম বৃদ্ধির পথকেও প্রশস্ত করেছে। আর এসব অপরাধের অনেকগুলোই ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টেলিগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো তথ্য চুরি হচ্ছে। এছাড়া জালিয়াতি থেকে শুরু করে অনলাইন জুয়া এবং ব্ল্যাকমেইলের মতো অপরাধমূলক কার্যক্রমকে সহজতর করার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমানভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
পারস্পরিক যোগাযোগ এবং ব্যবসার জন্য মানুষ যত বেশি ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকছে, অপরাধীরা এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে তত বেশি পরিমাণে ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে কাজে লাগানোর সুযোগটি লুফে নিয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে সাধারণ সাইবার অপরাধের মধ্যে রয়েছে পরিচয় হ্যাকিং, ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি, অনলাইনে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং স্ক্যাম এবং জুয়া।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্ল্যাকমেইলিং
সাইবার ক্রাইমের সবচেয়ে পীড়াদায়ক ধরনগুলোর একটি হলো ব্ল্যাকমেইলিং।
২৫ বছর বয়সী শোভা (আসল নাম নয়) ফেসবুকে পরিচয় হওয়া এক ব্যক্তির সঙ্গে লং ডিসট্যান্স সম্পর্কে জড়ানোর সময় তার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময় হিসাবে যা শুরু হয়েছিল তা শিগগিরই ভিডিও কলের সময় ছবি প্রকাশের জন্য অনুপযুক্ত অনুরোধে পরিণত হয়েছিল।
শোভা লোকটিকে বিশ্বাস করে মেনে নিল। কিন্তু এর পরপরই তার আচরণ খারপ দিকে মোড় নেয়। তিনি বড় অঙ্কের টাকা দাবি করতে শুরু করেন এবং যখন তিনি তা অস্বীকৃতি জানান, তখন তিনি তার ছবি এবং ভিডিও অনলাইনে প্রকাশের হুমকি দেন।
পরিস্থিতি তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। কিন্তু একজন সিনিয়র মেন্টর এবং বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের সহায়তায় শোভা লোকটির অ্যাকাউন্ট থেকে ছবিগুলো সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হন। তবে ঘটনার মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেক দিন পর্যন্ত।
ফেসবুকের ভুয়া পেজের মাধ্যমে প্রতারণা
আরেকটি প্রচলিত সমস্যা হলো অনলাইনে প্রতারণা, বিশেষ করে ভুয়া ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, অনিক (ছদ্মনাম) একটি আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য ফেসবুক পেজ থেকে একজোড়া ব্র্যান্ডেড জুতা অর্ডার করেছিলেন, যা ব্যাপক পর্যালোচনা এবং একটি বড় অনুসরণকারী বৈশিষ্ট্যযুক্ত।
পেজটিতে অগ্রিম পেমেন্টের প্রয়োজন ছিল, যা অনিক সরল বিশ্বাসে করেছিলেন। কিন্তু সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, জুতা আর পৌঁছাল না হাতে। এমন পরিস্থিতিতে বিক্রেতার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও অনিক ব্যর্থ হন এবং অগ্রিম দেওয়া অর্থ আর ফেরত পাননি।
দুর্ভাগ্যক্রমে, এটি কোনো একক ঘটনা নয়— অনেক ভুক্তভোগী প্রতিদিন একই ধরণের প্রতারণার শিকার হন।
হানি ট্রাপে তরুণরা
সম্ভবত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামনে আসা সবচেয়ে উদ্বেগজনক সাইবার অপরাধগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘হানি ট্র্যাপ।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার অপরাধ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, এই ফাঁদ বা প্রতারণা সাধারণত ফেসবুক থেকে শুরু হয়। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে ভিডিও কল করা হয়।
প্রতারক একজন নারী সেজে ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথোপকথনে জড়াবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের পুরোপুরি নগ্নভাবে ভিডিও কল করতে বলবে।
এরপর ভুক্তভোগীর আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করাই এই কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত লক্ষ্য।
অপরাধীরা প্রায়শই বাংলাদেশের বাইরে থেকে এসব কাজ করে। এসবের বেশিরভাগই ভারত থেকে করা হয়।
ভুক্তভোগীদের মানসিক ও আবেগীয় প্রভাব ভয়াবহ হয়। কেউ কেউ অবিরাম প্রতারণার কারণে আত্মহত্যাসহ চরম পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে যায়।
বাড়ছে অনলাইন জুয়া
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, অনলাইন জুয়া একটি বিপজ্জনক আসক্তি হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে।
দ্রুত উপার্জনের লোভ, স্মার্টফোনের মাধ্যমে জুয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সহজে ব্যবহারের সুযোগ একটি গুরুতর সমস্যা তৈরি করেছে।
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার শাহজাহান হোসেন বলেন, প্রকাশ্যে জুয়া প্রতিরোধে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ এখনো দুর্বল।
তিনি বলেন, সাইবার জুয়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন আমাদের নেই। তবে সরকারের নতুন উদ্যোগে এসব সমস্যা মোকাবিলা করা অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
অনলাইন জুয়াখেলার বিপজ্জনক প্রলোভন নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এসব আরও বেড়েছে, যা তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আসক্তি এবং আর্থিক ক্ষতিতে ফেলছে।
ইনস্টাগ্রাম: হয়রানির জন্য একটি কেন্দ্রস্থল
ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোও সাইবার অপরাধের উৎস হয়ে উঠেছে।
নাজমুল ইসলাম ব্যাখ্যা করেছেন, ইনস্টাগ্রামে সবচেয়ে সাধারণ অপরাধগুলোর মধ্যে একটি হলো সাইবার স্টকিং। অপরাধীরা নাগরিকদের হয়রানির জন্য প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে। কখনও কখনও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রোফাইলে পাওয়া ব্যক্তিগত তথ্য কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনে তাদের শনাক্ত করে এবং ভয় দেখায়।
ইনস্টাগ্রামে আরেকটি প্রচলিত অপরাধ হলো জালিয়াতি। অপরাধীরা নকল পণ্য বা পরিষেবাদির বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে। এই প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনগুলো প্রায়শই সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সাইবার অপরাধের উদ্দেশ্য
এই সাইবার অপরাধগুলো বেশিরভাগের পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য হলো অর্থ উপার্জন বা চাঁদাবাজির ইচ্ছা। অপহরণ, জালিয়াতি বা অনলাইন জুয়ার মাধ্যমেই হোক না কেন, অপরাধীরা আর্থিক লাভের কারণে এসবে অনুপ্রাণিত হয়, প্রায়শই নির্দোষ ব্যক্তিদের ক্ষতি করে।
কঠোর আইন প্রণয়নের আহ্বান
এই সাইবার অপরাধ বাড়তে থাকায় বিশেষজ্ঞরা আরও শক্তিশালী আইন এবং এর আরও কঠোর প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকার নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই অপরাধের জটিলতা এবং ক্রমবর্ধমান প্রকৃতি এটিকে একটি অবিরত চ্যালেঞ্জ পরিণত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাইবার ক্রাইমের শিকড় প্রযুক্তির মধ্যে থাকতে পারে। তবে এর প্রভাব খুব বাস্তব। ভুক্তভোগীদের মানসিক, আর্থিক এবং শারীরিকভাবে প্রভাবিত করে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাই আধুনিক যুগে এই অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনসাধারণ এবং কর্তৃপক্ষ উভয়েরই সতর্ক ও সক্রিয় হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।