ইনুকে ডান্ডাবেড়ি পরানোয় পুলিশকে হুমকি

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডান্ডাবেড়ি পরানোয় পুলিশের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়ান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান এবং হাসানুল হক ইনু। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু পুলিশ সদস্যদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘তোদের চৌদ্দগোষ্ঠী খেয়ে ফেলবো।’

রবিবার (২০ এপ্রিল) সকালে প্রিজনভ্যান থেকে নামিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়ার সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, যদি কোনও আসামি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে, তবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। আর পুলিশও যাতে বাড়াবাড়ি না করে, সেদিক খেয়াল রাখতে বলেছেন।

পরে শুনানি শেষে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে করা পৃথক দুটি মামলার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় আরও দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২৪ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রবিবার এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

দুটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। অপর মামলায় শেখ হাসিনার সাথে আসামি সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ৪৬ জন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, আমলা। পূর্ব নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী রবিবার এসব মামলার মোট ১৭ আসামিকে গতকাল সকালে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

তারা হলেন—সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, শাজাহান খান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ, কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক সচিব জাহাংগীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

ট্রাইব্যুনালে হাজির করার সময় হ্যান্ডকাফ পরানো নিয়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান সাবেক দুই মন্ত্রী। এরপর বিচারকাজ শুরুর আগে, ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার সময় শাহজাহান খান তার হাতে হ্যান্ডকাফ দেখিয়ে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। এটা আমার জন্য অমর্যাদাকর। তার আইনজীবীও এই বিষয়টি আদালতের কাছে তুলে ধরেন। এসময় ট্রাইব্যুনালের বিচারক ‘কী হয়েছে’ তা জানতে পুলিশ সদস্যদের ডেকে পাঠান।

পুলিশ সদস্য নুরুন্নবী ট্রাইব্যুনালকে জানান, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী আসামিদের এভাবে হাজির করা হয়। তখন আরেক পুলিশ সদস্য শহীদুল বলেন, প্রিজন ভ্যান থেকে নামানোর সময় তাদের রাজাকারের বাচ্চা বলা হয় এবং বলা হয় তোদের দেখে নেবো।

শহীদুল বলেন আরও বলেন, হাসানুল হক ইনু পুলিশ সদস্যদের বলেন ‘তোদের চৌদ্দগোষ্ঠী খেয়ে ফেলবো’। হাজতখানায় এসে মিটিং করে ফের পুলিশ সদস্যদের হুমকি দেয়। কাঠগড়ায় থাকা হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, শাহজাহান খান, কামরুল ইসলাম বলেন, না না তারা এসব বলেনি। সব মিথ্যে কথা। এর জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, যদি কোনও আসামি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে তবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। আর পুলিশও যাতে বাড়াবাড়ি না করে সেদিক খেয়াল রাখতে হবে।

গণ-অভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গত ১৭ অক্টোবর এই দুই মামলার প্রথম শুনানি হয়। সেখানে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ এই ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তারপরও শেখ হাসিনার মামলায় আরও একজনকে আসামি করা হয়। এ নিয়ে এই দুটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় তিনবার বাড়ানো হলো।

শুনানি শেষে চীফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলার শুনানি হয়। প্রথম মামলাটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের। এ মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জন আসামি রয়েছেন, যারা এই অপরাধের নির্দেশদাতা ছিলেন। মামলার ১৭ জন আসামি উপস্থিত ছিলেন। আমরা আদালতে এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে একটি রিপোর্ট দিয়েছি এবং দুই মাসের সময় চেয়েছি। আদালত আমাদের দুই মাস সময় দিয়েছেন।

মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, পরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুটি মামলার শুনানি হয়। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সম্পৃক্ততার বিষয়ে যে মামলাটি রয়েছে সেটির বিষয়ে আমরা আদালতকে জানিয়েছি, আমাদের তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হবে। তারপরও আমরা সত্যতার জন্য দুই মাসের সময় চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেছিলাম। আদালত আবেদন মঞ্জুর করেছেন।

তিনি আরও বলেন, তৃতীয় যে মামলাটির শুনানি হয়, সেটি হলো গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রসফায়ার নিয়ে। এই মামলাটিতে আমরা ১১ জনের বিরুদ্ধে শুরু করেছিলাম। মামলায় মাত্র একজন গ্রেপ্তার আছেন, তিনি হলেন সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান। শতশত গুমের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে কয়েকটি অভিযোগের তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তারপরও আমরা আদালতের কাছে তিন মাস সময় চেয়েছিলাম, আদালত সেটি মঞ্জুর করেছেন। এই সময়ের মধ্যে গুমের অভিযোগগুলোর বিষয়ে তদন্ত-প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

এদিকে আদালতে আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান খানকে হাতকড়া পরিয়ে তোলার সময় ওই নেতা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিতর্কে জড়ান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চীফ প্রসিকিউটর বলেন, আসলে এ বিষয়টি আমাদের এখতিয়ার না। আদালতে আসামিকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে তোলা হবে কি না; সেটা জেল অথরিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আসামিকে যদি কন্ট্রোল করতে না পারা যায় এবং তার পক্ষ থেকে যদি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে তাহলে তাকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বা আরও জটিল কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করে আদালতে তুলতে পারে জেল কর্তৃপক্ষ।

তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর সদস্যরা আদালতকে জানিয়েছেন, বিশেষ করে হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান ও জিয়াউল হাসান তাদের নির্বংশ করার হুমকি দিয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করেছেন। এছাড়া এদের মধ্যে একজন তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হেলমেটও ছুড়ে মেরেছেন। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা ঝুঁকি মনে করে তাদের হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আদালতে তুলেছে। তারা সেটা আদালতকে জানিয়েছে।