দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত সেনাবাহিনীর, মবের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জনসাধারণের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের মব সহিংসতা ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাহিনীটি।
সোমবার (২৬ মে) দুপুর দেড়টায় ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম।
দেশের চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, 'বর্তমানে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সম্পদের নিরাপত্তা প্রদানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।'
প্রধান সেনা কর্মকর্তার নির্দেশনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা সদস্যরা বর্তমানে ৬২টি জেলায়, এমনকি দূরবর্তী চরাঞ্চলেও সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন বলে জানান কর্নেল শফিকুল।
তিনি আরও জানান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে, একটি সমন্বিত ও বিস্তৃত পরিকল্পনার আওতায় এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এসময় লে. কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'গত ৫ আগস্টের পর থেকে সেনাবাহিনী দেশের স্বার্থে সবার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না।'
মব তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিষয়ে সতর্ক করে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, 'কেউ যদি মব তৈরি করে বিশৃঙ্খলা করতে চায়, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সেনাবাহিনী।'
সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি কারখানা থেকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্য তৈরিকৃত ২০,৩০০ পোশাক উদ্ধারের বিষয়ে লে. কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'এই ঘটনাটি উদ্বেগজনক। সেনাবাহিনী গভীরভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।'
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার, কোরবানির পশুর হাটে চাঁদাবাজি রোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন দায়িত্বপালন অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, 'বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একতাবদ্ধ থেকে সবসময় দেশের জনগণের পাশে রয়েছে এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে বদ্ধপরিকর।'
দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সমসাময়িক সময়ে সেনাবাহিনীর দৈনন্দিন আভিযানিক কার্যক্রম সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গত ৪০ দিনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২৪১টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও ৭০৯ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে।
২০২৪ সালের আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৬১১টি অবৈধ অস্ত্র এবং ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
পাশাপাশি, গত এক মাসে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ১ হাজার ৯৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার ফলে এ সময়ে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ২৬৬ জনে।
এদের মধ্যে রয়েছে- কিশোর গ্যাং সদস্য, তালিকাভুক্ত অপরাধী, অপহরণকারী, চোরাচালানকারী, প্রতারক, দালাল, চাঁদাবাজ, ডাকাত ও ছিনতাইকারী।
২০২৫ সালের ২০ মে ঢাকার ভাষানটেক এলাকায় পরিচালিত একটি বিশেষ অভিযানে কুখ্যাত সন্ত্রাসী হিটলু বাবুসহ ১০ জন গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ৪০ দিনে যৌথ অভিযানের মাধ্যমে ৪৮৭ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৪০০ জন মাদক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
অভিযানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা ও অবৈধ মদ উদ্ধার করা হয়েছে।
গত এক মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শিশুখাদ্যসহ বিভিন্ন ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি যশোর ও সাতক্ষীরায় জেলি পুশকৃত চিংড়ি জব্দ ও সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট সদস্যদের গ্রেপ্তারে বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এসব উদ্যোগ খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি, জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনী। এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৫৯৬ জন আহতকে দেশের বিভিন্ন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৩৬ জন এখনও চিকিৎসাধীন।
২০২৪ সালের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যার পর কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলায় গৃহহীন ও দরিদ্রদের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ৩০০টি ঘর নির্মাণ করে।
চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ঘর সুবিধাভোগী পরিবারের হাতে তুলে দেন।
উল্লেখ্য, সেনাবাহিনী যথাসময়ে প্রকল্পটি সম্পন্ন করেছে এবং বরাদ্দকৃত বাজেটের মাত্র অর্ধেক ব্যয় করেই কাজ শেষ করেছে, যা সততা ও দক্ষতার অনন্য নিদর্শন হিসেবে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে।