অন্তর্বর্তী সরকারে হাসিনার ‘ছায়া’ দেখছেন আনু মুহাম্মদ

মানুষ যে প্রত্যাশা নিয়ে গত বছর হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছিল, জন্ম দিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানের, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, বরং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে হাসিনা সরকারেরই ছায়া দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ।

তিনি বলেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, চব্বিশের অভ্যুত্থানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে। ফলে নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের দ্রোহযাত্রাও অব্যাহত থাকবে।

গত বছরের জুলাই-অগাস্টে কোটা আন্দোলন ঘিরে যে বিক্ষোভ ছড়িয়েছিল, তাতে শক্তি যুগিয়েছিল দ্রোহযাত্রা।

২০২৪ সালের ২ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘শিক্ষার্থী-জনতার দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি থেকে হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবি তুলেছিলেন আনু মুহাম্মদ। সেদিন আনু মুহাম্মদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি আজ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফায় এসে ঠেকেছে। হাসিনা সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।

দ্রোহযাত্রার পরদিন শহীদ মিনার থেকে ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম এক দফা ঘোষণা করেন। দ্রোহযাত্রার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শনিবার একই নামে কর্মসূচি পালন করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

আয়োজকরা বলছেন, দ্রোহযাত্রার আয়োজক কোনো ব্যক্তি নয়, সংগঠনও নয়। এই দ্রোহযাত্রা সেই সব মানুষের, যারা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে চলেছেন।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিলোপ, চব্বিশের গণহত্যাসহ পাহাড় ও সমতলের সব হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং নব্য-ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রতিহতের দাবিতে শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার দ্রোহযাত্রা অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দেওয়া হয় সভার মঞ্চ থেকে।

বিকালে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে দ্রোহযাত্রার সূচনা হয়। পরে একে একে গাওয়া হয় মুক্তির মন্দির সোপান তলে, ধন ধান্য পুষ্প ভরা, কারার ওই লৌহ কপাট, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়সহ প্রভৃতি গান।

আবৃত্তি করেন দীপক কুমার গোস্বামী ও হাসান ফখরী। মঞ্চের ব্যানারে লেখা দেখা যায়, জনবিধি সতর্কীকরণ, জুলাই বিক্রির জন্য নহে।

সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ বলেন, গত বছর দ্রোহযাত্রায় অসংখ্য মানুষ যুক্ত হয়েছিল মুক্তির আশা নিয়ে, তা পূরণ হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয় দেখানোর সব যন্ত্র যখন তুচ্ছ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তটাই হচ্ছে গণঅভ্যুত্থান। ৫২, ৬৯, ৭১ ও ৯০ সালেও আমরা অভ্যুত্থান দেখেছি। সবগুলো পর্বে জনগণের শক্তি দেখেছি। কিন্তু জনগণের বিজয় দেখিনি।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে শেখ হাসিনা সরকারের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। সেই একই নিপীড়ন, একই বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। গত বছর অভ্যুত্থানে যারা প্রধান শক্তি ছিল, তারাই এখন বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। নারী আক্রান্ত হচ্ছে, পাহাড়ের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।

আনু মুহাম্মদ বলেন, চব্বিশের অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল কর্মসংস্থানের দাবিতে। অথচ এই সরকারের সময় শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে। মব সন্ত্রাস তৈরি করা হয়েছে। আমরা সরকারকে দায়ী করতাম না, যদি দেখতাম সরকার এগুলো থামাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকার সেটি করছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীল কেউ কেউ মব উসকে দিচ্ছে।

হাসিনা সরকারের মতোই বর্তমান সরকারও বিদেশিদের সঙ্গে 'গোপন চুক্তি' করছে মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ইউনূস সরকার কী কারণে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেবে? কী কারণে বোয়িং বিমান কেনার চুক্তি করতে হবে? ভারতের আধিপত্যবিরোধী কথা মুখে বলছে, কিন্তু ভারতীয় আধিপত্যের পক্ষের চুক্তি কেন বাতিল করছে না? ট্রাম্প সরকারকে খুশি করার জন্য গোপন চুক্তি করবেন, তাহলে তো জনগণের দ্রোহযাত্রা অবশ্যই চলমান রাখতে হবে।

আনু মুহাম্মদ দাবি তোলেন, অভ্যুত্থানে আহতদের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে; শহীদদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে; হত্যার বিচার করতে হবে। মামলা বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি করা চলবে না। নারী, জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ, তা বন্ধ করতে হবে। আদালতকে স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে। নির্বাচনে অতীতের মতো পেশীশক্তির ব্যবহার, কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধকে যারা ছোট করতে চায়, তারা চব্বিশের অভ্যুথানেরও শত্রু মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের সম্পত্তি নয়। মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের দখলে আনতে হবে। চব্বিশের অভ্যুথানকেও চাঁদাবাজ ও দখলদারদের হাত থেকে জনগণের কাছে আনতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের কোনো একক কৃতিত্ব দাবি করার সুযোগ নেই। এই অভ্যুত্থানে শ্রমিক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। দ্রোহযাত্রা টুকরো টুকরো আলাদা মানুষকে এক করতে পেরেছিল। শ্রমজীবী মানুষকে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারলেই দ্রোহযাত্রা সফল হবে।

আওয়ামী লীগের সরকারের সময় গুমের শিকার মাইকেল চাকমা বলেন, নতুন বাংলাদেশে যে অন্তর্ভুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল পাহাড়ের জনগণ, তা পূরণ হয়নি। পাহাড়ে সেনাশাসন এখনো অব্যাহত আছে। আওয়ামী সরকারের নিপীড়নমূলক শাসন এখনো পাহাড়ে বহাল আছে।

সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন যাত্রাবাড়লি শহীদ মিরাজের বাবা আব্দুর রউফ, রিকশা চালক আব্দুল কুদ্দুছ ও নারীনেত্রী সীমা দত্ত।