ভারতজুড়ে সাংবাদিকতার কঠিন সময়
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর ড্যামোক্লেসের তরবারি ঝুলছে। যদিও দেশটির শীর্ষ আদালত সরকারের সমালোচনা করে পরিস্থিতি কিছুটা হালকা করেছে।
২০২৪ সালের মার্চে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সরকারের ভুয়া ও মিথ্যা খবর শনাক্তকরণে ফ্যাক্ট চেকিং ইউনিট (এফসিইউ) গঠন ও বলবতের বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করে দেন। বম্বে হাইকোর্টে মূল মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।
তথ্যপ্রযুক্তি রুলস-২০২১ সংশোধন করে নরেন্দ্র মোদী সরকার ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল ভারতের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর (পিআইবি) অধীন ফ্যাক্ট চেকিং ইউনিট গঠন করেছিল। এই ইউনিটকে সরকার ও ব্যবসা সংক্রান্ত “ভুয়া, মিথ্যা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” খবর শনাক্তকরণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। পাশাপাশি তারা ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এক্সের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এসব কনটেন্ট অপসারণ করতো।
সাংবাদিকরা মনে করেছেন এটি তাদের সরকারের কথা ও কাজের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার স্বাধীনতার সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘সরকার কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা যাচাই বা নির্ধারণের পূর্ণ ক্ষমতা পিআইবিকে দিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে কোনো তথ্য তুলে নেওয়ারও সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’ এই বিষয়টির বিরুদ্ধে প্রাদেশিক আদালতে যারা পিটিশন করেছে তাদের মধ্যে অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ান ম্যাগাজিনও ছিল।
এমন পরিস্থিতি ভারতে এক দিনে তৈরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শাসনামলে গত এক দশকে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে রোধ করার এবং পুলিশি মামলাসহ বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করে সাংবাদিকদের চুপ করার চেষ্টা করার পায়তারা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যদিও সরকার এইসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব জার্নালিস্টস (এনএজে), নেটওয়ার্ক অব উইমেন ইন মিডিয়া ইন্ডিয়া (এনডব্লিউএমআই) এবং ইজিআই’সহ সাংবাদিক সংগঠনগুলো প্রস্তাবিত ব্রডকাস্টিং সার্ভিসেস (রেগুলেশন) বিল-২০২৩ এর বিরুদ্ধে গুরুতর আপত্তি জানিয়েছে। যেটিকে তারা সেন্সরশিপের প্রবেশদ্বার এবং অঘোষিত সেন্সরশিপের একটি নতুন যুগের সম্প্রসারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)– একটি বৈশ্বিক মিডিয়া ওয়াচডগ। সংস্থাটির প্রকাশিত বার্ষিক প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত দিন দিন নিচে স্থান পাচ্ছে। ২০২৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত র্যাংকিংয়ে ১৭৬টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৫৯ নম্বরে। গত বছরের থেকে দুই ধাপ উন্নতি হয়েছে ভারতের। এই উন্নতি অবশ্য ভারতের গণমাধ্যমের বাস্তব পরিস্থিতির জন্য সুখকর কিছুর প্রতিফলন নয়।
গণমাধ্যমের জন্য ভারত সম্প্রতি আরও কঠোর আইন গ্রহণ করলেও র্যাংকিংয়ে দুই ধাপ উন্নতি হয়েছে। যদিও বর্তমান অবস্থাও গণতন্ত্রের অযোগ্য বলে জানিয়েছে আরএসএফ। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত মিডিয়া মালিকানা এবং রাজনীতিকীকরণের বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকটে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে আরএসএফ।
যদিও ভারতের মূলধারার টিভি নিউজ চ্যানেলগুলোর অধিকাংশই সরকারের হয়ে ইতিবাচক প্রচারের প্রতিযোগিতা করছে। তারা সরকারের একরকম উপাসনা করছে। অন্যদিকে, সরকারকে প্রশ্নকারী সাংবাদিকরা বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছেন।
নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থের কথাই ধরুন। মোদী সরকারের সমালোচনামূলক কাভারেজের জন্য পরিচিত একটি বামপন্থী ডিজিটাল গণমাধ্যম নিউজক্লিক। নিউজক্লিক ইতিমধ্যেই ২০২১ সাল থেকে কথিত আর্থিক অনিয়মের জন্য সরকারি কার্যক্রমের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু আদালত পুলিশকে জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল।
২০২৩ সালের অক্টোবরে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে মার্কিনভিত্তিক চীনপন্থী সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠার দুই মাস পর সরকার গণমাধ্যমটির কার্যালয় এবং এর সাথে যুক্ত সাংবাদিকদের বাসভবনে এবং এমনকি যারা পোর্টালটিতে অবদান রেখেছিল তাদের বাড়িতে পর্যন্ত অভিযান চালায়।
পুরকায়স্থ এবং অন্যান্য কর্মীদের ২০২৩ সালের অক্টোবরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করার জন্য চীনের কাছ থেকে অবৈধ তহবিল পাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
ইজিআই, প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া (পিসিআই) এবং ডিজিপাবসহ সমস্ত বড় সাংবাদিক সংগঠনগুলো এই অভিযানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইজিআই বলেছে যে, তারা উদ্বিগ্ন যে অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ‘কঠোর আইনের ছায়ায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা।’ সম্প্রতি, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পুরকায়স্থের গ্রেপ্তারকে বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করেছে।
শুধু যে নিউজক্লিক, তা নয়। সরকারি পদক্ষেপের মোকাবিলা করতে হয়েছে আরও গণমাধ্যমকে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল সময়ে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর দ্বারা মিডিয়া হাউস এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, সমন বা নোটিশের অন্তত ৪৪টি ঘটনা ঘটেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মিডিয়া-মনিটরিং সাইট নিউজলন্ড্রি।
এই মামলাগুলোর মধ্যে নয়টি আয়কর বিভাগের সাথে যুক্ত, ১৫টি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের সাথে এবং ২০টি জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) সাথে জড়িত। নিউজলন্ড্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম দুটি সংস্থা অর্থাৎ, আয়কর বিভাগ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টর আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে। আর এনআইএ সন্ত্রাস তদন্তে বিশেষজ্ঞ। নিউজলন্ড্রি নিজেই সরকারি হয়রানির শিকার হয়েছে। তাদের অফিস চত্বরে অভিযান চালানো হয়েছিল। এর সাংবাদিকদের ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের দ্বারা হয়রানি করা হয়েছিল।
পুলিশি মামলার শিকার একজন সাংবাদিকের মতে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বজায় রাখা বর্তমান ভারতে অনেক ব্যয়বহুল। ব্যয়বহুল এই অর্থে যে, এতে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে যেমন মানসিক হয়রানি হতে হয়, তেমনি আর্থিক চাপও তৈরি হয়।
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য : একজন স্বাধীন সাংবাদিক, যিনি রাজনীতি, ইতিহাস, মানবাধিকার, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে লেখালেখিতে যুক্ত। তিনি দুটি বই লিখেছেন- ‘মিশন বেঙ্গল: এ স্যাফ্রন এক্সপেরিমেন্ট’ এবং ‘লালগড় অ্যান্ড দ্য লিজেন্ড অফ কিশানজি: টেলস ফ্রম ইন্ডিয়া’স মাওস্ট মুভমেন্ট’। তিনি দ্য ডিপ্লোম্যাট, আউটলুক ম্যাগাজিন, দ্য ওয়্যার, আল জাজিরা ইংলিশ, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, নিক্কেই এশিয়া, হাফপোস্ট, মঙ্গাবে, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, নিউজলন্ড্রি এবং প্রিন্টে নিয়মিত লিখে আসছেন।
(ইংরেজী থেকে অনুবাদ)