গণমাধ্যম তাহলে কার?
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে ভারত ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে ১৩৬তম অবস্থানে থাকলেও মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালে এসে ১৫৯তম অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটি। অথচ, ২০০৪ সালে কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্বাধীন জোট- ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) যখন ক্ষমতায় আসে তখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারত ছিল ১০৪ নম্বরে। দুই দশকের ব্যবধানে ৫৫ ধাপ পেছনে পড়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই দেশটি।
ভারতে ক্রমাগতভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপক পতন হয়েছে। কংগ্রেস-বামফ্রন্টের শাসনামলে এই সূচকে যে ভারত ১০৪তম অবস্থানে ছিল- সেটিকেও বাহবা দেওয়ার সুযোগ নেই। ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি কখনই প্রাধান্য পায়নি। না সেটা ইউপিএ কিংবা বিজেপির শাসনামলে।
ভারতীয় গণমাধ্যম সবসময় ব্যবসায় গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। দুয়েকটি ব্যতিক্রম যদিও আছে। তবে বেশিরভাগ প্রধান পত্রিকার মালিকরা বহু সম্পত্তির মালিক। বড় বড় পত্রিকার মালিকরা এতটাই ধনী ছিলেন যে তাদের পক্ষে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে স্বাধীনভাবে কাজ করে যাওয়াটা কঠিন। এই চরম সত্যটি খুব ভালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ১৯৮৬ সালে নির্মিত ‘নিউ দিল্লি টাইমস’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। শশী কাপুর ও ওম পুরী অভিনীত এই রাজনৈতিক থ্রিলারে সংক্ষিপ্তভাবে ভারতীয় মিডিয়ার চরম বাস্তবতাই যেন উঠে এসেছে।
এখানে ভারতীয় গণমাধ্যমকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের সঙ্গে তুলনা করাটা হবে বোকামি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। গণমাধ্যম সেখানে মালিকের বিভিন্ন ব্যবসায়িক স্বার্থ থেকে সুরক্ষিত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যমকে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়েছে। যা ভারতে এখনও কল্পনা করা যায় না।
স্বাধীনতা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বর্গ থেকে পড়বে না। এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আইন প্রণয়ন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণ বা ভোক্তার অভিপ্রায়ের মাধ্যমে এমনটি ঘটবে। ভারতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ব্যক্তিগত অধিকার বা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারা বেঁচে থাকার জন্য একটি গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল থাকে। সমাজ এই সামন্ত সম্পর্ককে স্বীকার করে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রত্যাশা করা আকাশকুসুম কল্পনার মতো। কারণ এটি সমাজ মোড়লদের স্বার্থে বিঘ্ন ঘটাবে; যেটা অন্যরাও সাদরে গ্রহণ করবে না।
সুতরাং, এই সমস্যাটি মূলত কংগ্রেস বা বিজেপির সমস্যা নয়; এখানে পাঠক-শ্রোতারা কী দেখতে বা পড়তে চান- এটি তারই প্রতিফলন।
ক্ষমতায় থাকাকালে কংগ্রেসও কাশ্মীরের জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়নি। তেমনটা হয়নি ভারতের কেন্দ্রে বামপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেও। পরিস্থিতি অনেকটা পাকিস্তানের বেলুচিস্তান কিংবা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো। এখন পুরো ভারতে বিজেপি সেটাই করছে যেটা কংগ্রেস কাশ্মীর বা মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তিশগড়ে করেছিল। অর্থাৎ, বিজেপি কংগ্রেসেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে।
তবে বিজেপি গণমাধ্যমের প্রতি হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। মালিক-সম্পাদক থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্তাদের পাশাপাশি গণমাধ্যমের মাঠ পর্যায়ের বা প্রান্তিক রিপোর্টাররাও কঠিন চাপের মধ্যে কাজ করছেন। কেরালা বা পশ্চিমবঙ্গে মতো রাজ্যেও এমনটি হয়নি তা নয়, তবে এখনকার পরিস্থিতি আগের সব পরিস্থিতিকে ছাড়িয়ে গেছে।
বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এখন প্রায় সব মূলধারার মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। গণমাধ্যম বা কারও পক্ষে এখন বনাঞ্চলে খনির অনুসন্ধানের আবেদন করা বা পরিবেশের ওপর খনির প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করা অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, বিজেপি তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী তথ্য এবং পরিসংখ্যান প্রদান করে একটি বিকল্প সংবাদ পরিবেশনের ব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। যেটি আগে অন্য দলগুলো পারেনি। এখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও শিখছে। প্রকৃতপক্ষে, তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছে। যেমনটা করেছিল ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার আলেকজান্ডার নিক্স বা স্টিভ ব্যানন।
তৃতীয়ত, গতানুগতিক উৎস-ভিত্তিক সংবাদ সংগ্রহের চল প্রায় শেষ করে দিয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম। যার কারণে ছোট বা মাঝারি আকারের গণমাধ্যম সংবাদ সংগ্রহের জন্য অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশ করতে তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
চতুর্থত, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিষয়টি নিয়ে কখনও চিন্তা করেনি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো। যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্রমাগত স্খলনের জন্যও দায়ী। নিরাপত্তা তো দূরের কথা, স্থানীয় সাংবাদিকদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা পর্যন্ত দেওয়া হয় না। তাদের সাংবাদিক পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হয়।
জনগণের কণ্ঠস্বর কোনোভাবেই রুদ্ধ করা যাবে না। এখন নাগরিক সাংবাদিকতা এসেছে। প্রযুক্তির সাহায্যে এর প্রসার ঘটবে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বন্ধু, স্বাধীন সাংবাদিক এই অবস্থাকে ভাঙার চ্যালেঞ্জ নেবে। অভিজ্ঞ লেখকরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরি করবে। যা একটি রূপালি দিনের আগমনকে নির্দেশ করে। ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে যেটি সারা বিশ্বেই ঘটবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ক্ষমতাসীনরা ডিজিটাল মাধ্যমকে রুদ্ধ করার পাঁয়তারা করছে। তাই ভারতে এর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
একথা অবধারিত যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এখানে একজন সাংবাদিকের উদ্ধতি বলতে হয়, যে সুড়ঙ্গের শেষে শুধু আলোর আশা না করাই ভালো, কারণ সেখানে টানেলের সমাপ্তিও হতে পারে।
শুভজিৎ বাগচী ১৯৯৫ সাল থেকে একজন পেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত। তিনি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, দিল্লিতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস এবং মধ্য ভারত ও কলকাতায় হিন্দু-এর সাথে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করছেন এবং বাংলাদেশের পূর্ব ভারত সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন।
(ইংরেজী থেকে অনুবাদ)