গণতন্ত্র না থাকলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও থাকে না
একটি দেশের সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথম যে উদ্বেগের বিষয়টি আমাদেরকে চিন্তিত করে সেটি হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে। সমাজে ও দেশে কী ঘটছে, সেটার প্রতিফলন ঘটে সংবাদমাধ্যমে। সে জন্য সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পন। সমাজের প্রতিবিম্ব তাতে প্রতিফলিত হয়।
সংবাদপত্রের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। তবে ইউরোপীয় সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রেরও বিকাশ হতে থাকে। মূলত ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম থেকেই বাংলা অধ্যুষিত এ অঞ্চলে সংবাদপত্র প্রকাশের প্রয়াস শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ সমাচার দর্পণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আরো কিছু সংবাদপত্র সে সময়ে প্রকাশ হয়।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে আরো বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। বিশ্বে যখন গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটে, তখন পাশ্চাত্য জগতে সংবাদপত্র বড় ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পাশ্চাত্য বিশ্বে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার প্রবণতা দেখা দেয়। অ্যালেক্স ক্যারি নামে একজন গবেষক দেখিয়েছেন সেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই পাশ্চাত্য জগতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। কাজটি করা হতো খুবই সুকৌশলে।
পরবর্তীতে কর্পোরেশনগুলো সংবাদপত্র দখল করে নিতে থাকে। কর্পোরেশনগুলোর একটা নিজস্ব স্বার্থ আছে। এই স্বার্থেই তারা সংবাদপত্রগুলোকে পরিচালিত করত। সংবাদপত্রের কৌশল ও সংবাদপত্রের বিষয়বস্তুগুলো তারা নির্ধারণ করে দিত। এর ফলে প্রকৃত অর্থে সাধারণ মানুষের সংগ্রাম, আকাঙ্খা, স্বপ্ন— কোনোটিই সংবাদপত্রে উঠে আসত না। বর্তমান অবস্থাও একই। তারপরও বিষয়টি এমন নয় যে জনগণ সম্পূর্ণভাবে সংবাদপত্র থেকে নির্বাসিত হয়ে গেছে অথবা সম্পূর্ণভাবে সংবাদপত্রের মধ্যে আছে। এখানে একটা দ্বান্দ্বিকতা কাজ করছে। যখন মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম জোরদার হয়, তখন সংবাদপত্রগুলো অনেক স্বাধীনভাবে তাদের মতপ্রকাশ করার চেষ্টা করে। আবার গণতান্ত্রিক সংগ্রাম যখন ম্রিয়মাণ বা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন জনগণ আপেক্ষিকভাবে অসচেতন অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। দেশে কী ঘটছে, সমাজে কী ঘটছে, সে নিয়ে মানুষ যখন খুব একটা চিন্তিত থাকে না, ঠিক তখন সংবাদপত্রগুলোও প্রতিক্রিয়াশীল, শাসক এবং শোসক গোষ্ঠিদের স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। এটি সব দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বাস্তব অবস্থা।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে দেশটির নাম ছিল পূর্বপাকিস্তান। পাকিস্তানিদের শাসনামলে এখানে সংবাদপত্রের সংখ্যা খুব সীমিত ছিল। দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে ৪-৫টি সংবাদপত্রের নাম বলা যাবে। যেমন- ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান, পাকিস্তান অবজারভার, মর্নিং নিউজ। এগুলো মোটা দাগে তখনকার গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকা। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশন নামে প্রথম কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকেই টেলিভিশনের মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন, রাজনৈতিক পর্যলোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্পসাহিত্যমূলক অনুষ্ঠান প্রচার হত। পাশাপাশি ছিল রেডিও। রেডিও এবং টেলিভিশন- দুটিই ছিল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। সংবাদপত্রগুলোর স্বাধীনতাও ছিল সীমিত। বিশেষ করে তাদেরকে বলা হতো, পাকিস্তানের মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু প্রকাশ করা যাবে না। সেটা করলে সংবাদপত্রের নৈতিকতা বা এথিক্স ভঙ্গ করা হবে বলে তখন বলা হতো।
আইয়ুব খানের আমলে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স-এর খড়গ মাথার ওপরে রেখে সাংবাদিকদের ও সংবাদপত্রের সম্পাদকদেরকে কাজ করতে হতো। ইত্তেফাক পত্রিকা সে সময় বাঙ্গালি স্বার্থের বিষয়গুলো খুব উচ্চকিতভাবে তুলে ধরত। ১৯৬৭ সালের দিকে ইত্তেফাকের ওপরেও খগড় নেমে আসে। ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত ইত্তেফাক পত্রিকা বেআইনি ছিল, সম্পাদক ছিলেন জেলে। গণঅভ্যুত্থান একটা পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর ইত্তেফাকের প্রকাশনা চালু করা হয় এবং ইত্তেফাক আবার তার পুরোনো স্বাধীনতা, পুরোনো অবস্থান ফিরে পায়।
এ থেকে একটা বিষয় প্রমাণিত হয়, দেশে যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চর্চা থাকে, তাহলে কোনো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর পক্ষে সংবাদপত্রকে শৃঙ্খলিত করা সম্ভব হয় না। কিন্তু সমাজের মধ্যে যদি সে রকম আন্দোলন-সংগ্রাম এবং প্রতিবাদ না থাকে, তাহলে সংবাদপত্রগুলোও সত্যিকার অর্থে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে না।
স্বাধীনতা অর্জনের পর পর বাংলাদেশের সংবাদপত্রের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেখা যায়। ১৯৭২-৭৩ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা ছিল। এর মধ্যেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধ করা হয়েছে। যেমন প্রথম দিকে গণশক্তি নামে সাপ্তাহিক একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হতো। সেই গণশক্তির ওপর প্রথম খড়গ নেমে আসে স্বাধীন বাংলাদেশে। গণশক্তির ওপর খড়গ নামার কারণ হচ্ছে, পত্রিকাটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) মুখপাত্র। এটা মূলত সেই দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা দ্বারা পরিচালিত হতো। তার নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেসেই পত্রিকাটি ছাপানো হতো। কিন্তু মোহাম্মদ তোয়াহা তখন ছিলেন আত্মগোপনে। এদিকে পত্রিকা বের হচ্ছে প্রকাশ্যে এবং পত্রিকায় তখন ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের তীব্র সমালোচনামূলক খবর ও লেখা প্রকাশ হতে শুরু করে। সেই সময়কার লুটপাট, দুর্নীতি, অপশাসনের খবরও প্রকাশ হতে থাকে। ফলে এক পর্যায়ে সেই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯৭৪ সালের মধ্যে আরও কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে লাল পতাকা বলে একটি পত্রিকা। আছে স্পোকসম্যান বলে একটি পত্রিকা। আছে খুলনা থেকে প্রকাশিত দ্যা ওয়েব। দৈনিক কাগজ হিসেবে বের হওয়া গণকণ্ঠ রয়েছে এ তালিকায়। স্বাধীনতা অর্জনের পর পর দেশে গণতন্ত্রের মৃদ হওয়া বইতে শুরু করেছিল। মানুষ তখন ভাবতে শুরু করেছিল, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, স্বাধীনভাবে আমাদের মত প্রকাশ করবো, মতের প্রতিফলন ঘটাবো। কিন্তু সেই স্বাধীনতা ছিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য। চেকোস্লোভাকিয়া সম্পর্কে প্রাগ বসন্ত বলে যে একটা কথা বলা হয়, ঠিক সেটার মতো। ১৯৭১ সালের পর ৭২-৭৩ সালে সংবাদপত্রের একটা ফুরফুরে অবস্থা ছিল। কিন্তু সেই অবস্থা অচিরেই ম্লান হয়ে যায়। যখন শাসক গোষ্ঠীর সংকট, শাসনের সকট, অর্থনীতির সংকটগুলো খুব তীব্র আকার ধারণ করে, তখন শেখ মুজিবুর রহমান এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করলেন। এক দলীয় শসন ব্যবস্থার মাধ্যমে গোটা সংবিধানকে পরিবর্তন করা হয়। চারটি দৈনিক পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে শত শত সংবাদকর্মী এবং সাংবাদিক কর্মহীন হয়ে পড়েন। অন্যদিকে যে চারটি পত্রিকা রাখা হয়েছে, সেখানে শুধু সরকারের বক্তব্য ছাড়া বা সরকারের পছন্দের কথা বার্তা ছাড়া, অন্য কোনো কিছু ছাপানোর সুযোগ ছিল না। এই পত্রিকা চারটি হলো- নব আকারে প্রকাশিত ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজার্ভার, বাংলাদেশ টাইমস এবং দৈনিক বাংলা। এখানে সরকার নিজেই সম্পাদক নিয়োগ দেয়।
ইত্তেফকের মালিকরা তখন বলেছিলেন, ‘ইত্তেফাকের গায়ে যারা হাত দিয়েছে, তারা সবাই ধ্বংস হয়ে গেছে। আইয়ুব খান ধ্বংস হয়ে গেছে ইত্তেফাকের গায়ে হাত দিয়ে। এখন ইত্তেফাকের গায়ে হাত দেওয়া হয়েছে। এর থেকে কী হতে পারে, আপনারা চিন্তা করে দেখেন।’ যদিও এই ধরনের বিষয় কখনো আলোচনায় আসেনি। আমি শুধু আমার স্মৃতিগাঁথা থেকে কথাটা বলছি। কিন্তু এই ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশ এ ধরনের টোটালিটারিয়ান শাসন বা একনায়কতান্তিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আদর্শ জায়গা নয়। বাংলাদেশের মাটি এ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের মাটি, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের প্রকৃতি, বাংলাদেশের মানুষের মনমানসিকতা— এগুলোকে বর্জন করেছে। পরবর্তীতে পচাত্তরের বিয়োগাত্মক ঘটনা ঘটল। পরবর্তীকালে সংবাদপত্রগুলো আবার স্বমিহমায় ফিরে আসে। নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আগ পর্যন্ত দেশে খুব বেশি সংখ্যক সংবাদপত্র প্রকাশ হয়নি। যদিও ওই সময়ে বেশ কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা, বিশেষ করে বিচিত্রা এবং আরও কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়েছে। দুই-চারটি দৈনিক পত্রিকাও সেই সময় প্রকাশ হয়েছে। মফস্বল এলাকা থেকেও দৈনিক পত্রিকা বের হয়েছে। চট্টগ্রামে আগে থেকেই দৈনিক পত্রিকা বের হতো। দৈনিক আজাদীর কথা আমরা জানি।
সংবাদপত্রের পুনর্জন্মের সূচনা হলো নব্বইয়ের পর। যখন নব পর্যায়ের গণতন্ত্র চর্চা শুরু হলো। এই পর্যায়ে বেশ কিছু নতুন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে প্রথম আলো, সমকাল, যুগান্তরের কথা উল্লেখ করতে পারি। এছাড়া আরও কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। উক্ত সময়ে শাসক গোষ্ঠী পত্র-পত্রিকার ওপর মোটামুটি টলারেন্ট ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ২০০৭-০৮-সালের পর দীর্ঘ সময়ের জন্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আর ক্ষমতায় আসার পর তারা নতুন কৌশল গ্রহণ করে। সেই কৌশলটা সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে দেওয়া না, তবে সংবাদ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা। শুধু তাই নয়। নিজ দলীয় লোকদের দিয়ে তারা বেশ কিছু দৈনিক, বেশ কিছু সাপ্তাহিক, বেশ কিছু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রকাশ/চালু করল। এর আগে দেশে দুই-তিনটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছিল। কিন্তু যে সময়ের কথা আমরা বলছি, সে সময়ে ৪০-৪২টির মতো ইলেকট্রনিক মিডিয়া চালু হয়েছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে বুঝতে গেলে কনটেন্ট এনালাইসিস গুরুত্বপূর্ণ। সেই কনটেন্ট এনালাইসিস করা হলে প্রত্যেকটা ইলেকট্রনিক মিডিয়া একই কথা বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করছে। নতুন কিছু নেই তাতে। এমনকি কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও দেখছি না। সবাই সরকারের প্রশংসায় ব্যস্ত, আমি এর বিরোধী নই, তবে ভিন্নমতও প্রকাশ করতে হবে। দ্বিমত পোষণ করে বা ভিন্নতম পোষণ করে এমন কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। যদিও সরকার দাবি করছে- আমরা বহু পত্রিকাকে প্রকাশ করার সুযোগ দিয়েছি। বহু ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে জন্ম নেওয়ার সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এগুলো কুটকৌশলে নিয়ন্ত্রিত। নিজ দলীয় লোকদের মাধ্যমে এগুলোর প্রকাশনা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। নিজস্ব বিজনেস হাউজের মাধ্যমে এগুলোর প্রকাশনা হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকার পেছনে একটা নির্দিষ্ট বিজনেস হাউসের মালিকনা রয়েছে বা তারা নিয়ন্ত্রন করছে। বিজনেস হাউজগুলো তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। একইভাবে তাদের মালিকানায় অনেক ইলেকট্রনিক মিডিয়া চালু হয়েছে। আমি নাম উল্লেখ করতে চাই না। কিন্তু আমরা জানি, কোন ইলেকট্রনিক মিডিয়া কার মালিকানায় বা কোন বিজনেস হাউসের মালিকানায় রয়েছে। এখানে একদিকে আমরা দেখছি পলিফারেশন অব নিউজ মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া; আবার অন্যদিকে দেখছি প্রচন্ড ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারর মাধ্যমে শাসক গোষ্ঠীর গুণকীর্তনই প্রচারিত হচ্ছে সব সময়। শাসকগোষ্ঠী যাতে মোটামুটি নির্দ্বিধায় দেশ চালিয়ে যেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। যদি কোনো ক্ষেত্রে কোনো সম্পাদক একটু ব্যতিক্রমী ধরনের ভূমিকা পালন করেন, বা সরকারের কিছু কিছু দুর্বলতার দিকগুলো তুলে ধরেন, তখন ওই হাউজের ওপরে অনেক ধরনের চাপ নেমে আসে। সেই ক্ষেত্রে পত্রিকার সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো পর্যায়ে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমাও হচ্ছে। এখানে এক ধরনের গণতন্ত্রের ভান চলছে। যেমন বাচ্চারা পুতুল খেলে। সেখানে তারা স্বামী-স্ত্রী বানায়। রাজা-রানীসহ অনেক কিছু বানায়। এটাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন যেন যেন খেলা। যেন যেন গণতন্ত্র এখানে আছে। সংবাদমাধ্যম, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্র-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যেন যেন খেলা চলছে।
গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে গত ১৫-২০ বছরে, আমাদের এখানে গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে। এর উৎস ভিন্ন; যেমন ফেসবুক, এক্স। এগুলোর মাধ্যমে অনেকে মত প্রকাশ করছে। এর ফলে অনেক ব্যক্তি তার নিজস্ব মত, তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন। যদিও এটা কোনো অর্গানাইজড কিছু নয়, বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত। তবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সরকার এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও নানা ধরনের রেগুলেটরি বডি তৈরি করেছে। আইন তৈরি করেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তার মধ্যে অন্যতম। সেই আইনে অনেকে শাস্তিও ভোগ করেছে। কষ্টকর শাস্তিও ভোগ করেছে অনেকে। ফলে সেখানেও যে মানুষ একটু স্বস্তিরভাবে নিশ্বাস ফেলবে, সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। মানুষ সম্ভব করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর ফলে গোটা মিডিয়া, সেটা ইলেকট্রনিক বা সংবাদপত্র হোক, অথবা গণমাধ্যম হোক বড় বিপদ নেমে এসেছে। এখানে সেল্ফ সেন্সরশীপের ব্যাপার চলছে। অর্থাৎ আইনের ভয়, জেল-জুলুমের ভয়, নির্যাতনের ভয়, এসব মাথায় রেখে সবাই কলম নিয়ন্ত্রণ করে। খবর কতটুকু প্রকাশ করবে, কতটুকু করবে না, তা চিন্তা করে। এটি এরশাদের আমলে ছিল। প্রেস অ্যাডভাইজার দিয়ে খবর নিয়ন্ত্রণ করা হতো, এখন আর প্রেস অ্যাডভাইজ দিয়ে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় না। এখন প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেক সাংবাদিক, প্রত্যেক সম্পাদক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যারা কাজ করেন, তারা নিজেকেই নিজেরা অ্যাডভাইজ দেন।
আমাদের এখানে প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। যে গণতন্ত্র আছে, এটা সেই গণতন্ত্র, যেটাকে পাকিস্তান আমলে বলা হয়েছিল, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। আমরা এখন নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র শব্দটা মুখে উচ্চারণ না করলেও বস্তুত কর্মকাণ্ড ও প্রয়োগের দিক থেকে এর মধ্যে চলে গেছি। আবারও বলবো, গণতন্ত্র নিয়ে যেন যেন গণতন্ত্র খেলা এখানে চলছে।
সাংবাদিক ইউনিয়ন আজ দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে গেছে। দুটি বড় দলের লেজুড় হয়ে গেছে তারা। এর ফলে একদিকে সাংবাদিকদের পেশাগত স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তারা তাদের পেশাগত স্বার্থগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে পারছে না। অন্যদিকে পেশাগত স্বাধীনতার প্রশ্ন, পেশাগত যে ভূমিকা পালনের প্রশ্ন, সেখানেও তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে। সাংবাদিকদের মধ্যে এই ধরনের বিভেদ সৃষ্টি আমাদের দেশের জন্য খুবই আত্মঘাতী হয়েছে। যে কোনো মানুষের নিজস্ব মত বা নিজস্ব বিশ্বাস থাকতে পারে। প্রতিটি পেশার কতগুলো এথিক্স থাকে। ন্যূনতম মৌলিক কিছু নীতি নৈতিকতা থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ১৯৯১ সালের পর আমরা সাময়িকভাবে উৎফুল্ল হয়েছিলাম এই ভেবে যে গণতন্ত্রের জয় হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিরাশার বা হতাশারও কারণ আছে। আমাদের দেশে বড় দুটি দলের মধ্যে মেরুকরণ হয়ে গেল এবং একে অপরকে তারা সংহার করার রাজনীতির দিকে এগিয়ে গেল, এর যে ছাইভস্ম পতন হলো বা ছড়িয়ে পড়ল, তার ফলে আমাদের এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের পেশাগত সামর্থ্য অর্জন এবং তাদের নৈতিকভাবে পেশাগত কাজ করে যাওয়ার সুযোগগুলো সংকুচিত এবং সীমিত হয়ে গেছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক