সাংবাদিকের সাহস থাকতে হবে
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। রাষ্ট্রের প্রথম তিন স্তম্ভ হচ্ছে- প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও পার্লামেন্ট। এগুলোর সবই আবার জনগণের সামনে প্রতিফলিত হয় গণমাধ্যমের দ্বারা। সুতরাং, গণমাধ্যম কীভাবে এদের চিত্রিত করল, কীভাবে এদের প্রচার করল; এ ব্যাপারে এই তিন স্তম্ভের সবাই উদ্বিগ্ন থাকে। সুতরাং, গণমাধ্যমের শক্তি সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাই রাজনীতি-অর্থনীতিতে যখন আমরা গনমাধ্যমকে বিচার করব, তখন প্রথমেই গণমাধ্যমের শক্তির কথা স্বীকার করে নিতে হবে।
গণমাধ্যমের প্রচার শক্তি আছে। আছে জনমত সৃষ্টি করার শক্তি। এই প্রচার ও জনগত সৃষ্টিটা কোন দিকে যাচ্ছে, তার ওপর রাজনীতি এবং অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করে। সে জন্য রাজনীতি-অর্থনীতিতে গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনা অবশ্যই আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যম কোন দিকে যাবে? কার গুণকীর্তন করবে? কাকে পজিটিভ বলবে, কাকে নেগেটিভ বলবে? সেটা কীসের দ্বারাই বা নির্ধারিত হচ্ছে? নির্ধারিত হতে পারে মূল্যবোধের দ্বারা বা রাষ্ট্রীয় আদর্শের দ্বারা। আবার হতে পারে বিরোধী দলের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধের দ্বারা। সেই কারণে গণমাধ্যমকে নিয়ে টানাটানি আছে। সরকারের দিক থেকেও টানাটানি আছে। বিরোধী দলের দিক থেকেও টানাটানি আছে।
সাধারণভাবে জনগণ সরকারি গণমাধ্যমের প্রতি যতটা আকৃষ্ট হয়, তার চেয়ে বেশি আকৃষ্ট থাকে বিরোধী দলের গণমাধ্যমের প্রতি। কারণ, বিরোধী দলের গণমাধ্যম থেকে সমালোচনাটা হয়। সুতরাং, সাধারণভাবে মানুষ সেটাই শুনতে চায়। সাফল্যগাথা মানুষ শুনতে চায় না। মানুষ শুনতে চায় কোথায় সমস্যা, কোথায় সংগ্রাম, কোথায় জটিলতা। সেই সঙ্গে সেই সমস্যা-জটিলতাগুলো কীভাবে প্রকাশ করে সেটার সমাধান করা যায়, মানুষ সেটা শুনতে বা জানতে চায়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যমের একটা নিজস্ব অর্থনীতি আছে। গণমাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিক রাখতে হয়। সেই গণমাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য পয়সা খরচ করতে হয়। সেখানে যোগাযোগ রাখতে হয়। রেডিও, টিভি ইত্যাদি জিনিসের প্রোডাকশনের খরচ রয়েছে। সংবাদপত্রের প্রোডাকশন কস্ট রয়েছে। এখন যেহেতু সাইবার জগৎ, তাই সোশ্যাল মিডিয়ারও একটা কস্ট আছে। এই কস্টগুলো যেহেতু আছে এবং রিটার্নও আছে, সে জন্য গণমাধ্যম একটা ব্যবসাও বটে। সেই ব্যবসার মালিক কে এবং তার সঙ্গে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সম্পর্ক কী, সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
তাই উন্নত এবং উদার গণতন্ত্রের দেশে বিরোধী দলও শক্তিশালী, সরকারি দলও শক্তিশালী। সেই সঙ্গে উভয়ের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, চেকআপ-কাউন্টার চেকআপ আছে। সেখানে গণমাধ্যমও দুইটা ধারায় বিভক্ত থাকে। কেউ কেউ একটু সরকারের গুণকীর্তন বেশি করে। কেউ কেউ সরকারের সমালোচনা একটু বেশি করে। আবার উভয় মিলে অবজেকটিভ রিপোর্টিং হয়। সেই কারণে সেখানকার জনগণ গণমাধ্যমের প্রতি আগ্রহী থাকে।
কিন্তু যেখানে হিজ মাস্টার্স ভয়েসি প্রাধান্য অর্জন করে, না করলেও সরকার এবং শাসক শ্রেণি একদলীয় আধিপত্যমূলক ব্যবস্থার দিকে চলে যায়, যেখানে গণমাধ্যমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেখানে গণমাধ্যমের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকটা বশ্যতামূলক। এটা সরকার যে চাপ দিচ্ছে, সেটার কারণেও। আবার ভয়ে যে সেল্ফ সেন্সরিং হয়, সেটার কারণেও।
এই জায়গায় গণমাধ্যমের মালিকরা আবার কোনো পক্ষে অবস্থান করলে, সেটার একটি সযত্ন প্রভাব আমরা সংবাদপত্রের প্যাটার্নের মধ্যে দেখতে পাই। কোনো কোনো স্থূল মালিক আছেন, যারা ক্রুড। পত্রিকাকে তারা ব্যবহার করেন নিজের কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য এবং নিজের ব্যক্তিগত খ্যাতি প্রকাশ করার জন্য। সে ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের গুণ ও মান কমে যায়। কোনো কোনো সংবাদপত্রের মালিক আছেন, যারা সরকারের সঙ্গে কাজ করে সরকারের থেকে সুবিধা আদায় করতে চান। আমাদের এখানে যেমন পত্রিকার জন্য কাগজ ও বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সরকারের বড় ভূমিকা আছে। তাই অনেক সংবাদপত্র সরকারকে সন্তুষ্ট করে সুবিধাগুলো আদায় করতে চায়।
এখন সাংবাদিক এবং সম্পাদক কী ধরনের মূল্যবোধ নিয়ে সংবাদপত্রে এসেছেন, সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কিন্তু এখানে মূল্যবোধ এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক লাভ, এই দুটির মধ্যে একটি ট্রেডঅফ আছে। অনেক বড় বড় দামি কাগজ আছে, যারা অতটা মূল্যবোধের ধার ধারে না। কিন্তু যাদের হাতে টাকা আছে বা যাদের মালিকরা খুবই অর্থ বিত্তবান, তারা হয়তো সাংবাদিক কিনেই নিতে পারেন টাকা দিয়ে। তাদের পছন্দমতো সেই সংবাদপত্র চালাতে পারেন। তবে সত্যই সংবাদপত্র যদি সর্বসাধারণের মধ্যে কাটতি করতে হয়, তাহলে তার দুটি গুণ থাকতে হবে। একটি হচ্ছে অবজেক্টিভিটি। বাস্তব সত্যটাকে বাস্তবভাবে তারা তুলে ধরবে। আরেকটি হচ্ছে জনপ্রিয়তা। এ জন্য সংবাদ মাধ্যমগুলোকেই সেই সব খবর খুঁজে বের করতে হবে, যেটা পাঠকপ্রিয়তা পাবে। যেমন- আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোতে লুটপাট হয়। আমাদের দেশে নদী দখল হয়ে যায়। আমাদের দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট হয়। এগুলোর প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনগণ খুবই কষ্ট ভোগ করে। জনগণ চায় এই কাণ্ডগুলো কারা করছে, কীভাবে এই কাণ্ডগুলো হচ্ছে, সেটা প্রকাশ হোক। শীর্ষ ঋণখেলাপির কাণ্ডকারখানা প্রকাশিত হোক। শীর্ষ অর্থপাচারের গল্প প্রকাশিত হোক। নদী দখলকারী যেন শান্তিতে ঘুমাতে না পারে, সে জন্য তার খবরটা প্রকাশিত হোক।
যে সংবাদপত্রগুলো এসব অনুসন্ধান করে সত্য খবরটা দেয়, তাদের কাটতি বাড়ে। মানুষ খুঁজে খুঁজে সেই নিউজটা পরে। স্যোশাল মিডিয়াতে সেই নিউজের ওপর ক্লিক বেশি হয়। সুতরাং মার্কেট প্রিন্সিপালে আমরা যদি যাই, তাহলে কিছুটা পলিটিক্যাল ইকোনমির মধ্যে একটা ব্যালেন্সিং আসে। মার্কেটে সাপ্লাই এবং ডিমান্ডেনিংয়ের মাধ্যমে একটা ব্যালেন্সিংয়ের চেষ্টা থাকে।
সিন্ডিকেট করে সংবাদ প্রকাশ করা বড় একটা সমস্যা। হিটলার বা ফ্যাসিবাদী দেশে, চায়না অথবা মালয়েশিয়ায় লি কুয়ানের সময়ের কথা বলা যেতে পারে। এরকম দেশগুলোতে কতগুলো বর্ডার লাইন তারা তৈরি করে দেয়। বলা হয় এই বর্ডারের মধ্যে সংবাদপত্রগুলোকে থাকতে হবে। কতগুলো আইনও করে দেওয়া হয়। কোনটা কুৎসা, কোনটা মিথ্যা, কোনটা বাস্তবতা, সেই বিচার না করে, কোনটা আমার শাসন ব্যবস্থার পক্ষে, কোনটা আমার শাসনক্ষমতার বিরুদ্ধে, সেই বিচারটা করে তারা সংবাদ প্রকাশের সীমারেখা, শব্দচয়ন, ভাষা, প্রশংসা এবং নিন্দার মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। যখন এটা করে দেয়, তখন মানুষ সংবাদপত্র সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এমন একটা পত্রিকা যদি থাকে, তখন কিন্তু এটা বিকশিত হয় না। আবার যেখানে হয়তো গণতন্ত্র আছে, সংবাদপত্র আছে, আইন একটু শিথিল, কিন্তু সাংবাদিকরা সাহসী নয়, সেখানেও সংবাদমাধ্যম চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। অন্য তিন স্তম্ভের ভুল ধরিয়ে দিতে পারে না। সে জন্য আমার মনে হয়, সাহসী সাংবাদিক ও সাহসী সংবাদ বিভাগ দরকার। বিবিসিকে আমরা আদর্শ হিসেবে ধরতে পারি। যদিও তারা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং সোসাইটি হিসেবে আছে, কিন্তু তাদের একটা কোয়ালিটি, নিরপেক্ষিতা, অবজেক্টিভিটি আছে। সাহস এবং কোমরের জোড় আছে। এই জিনিসগুলো আমাদের সংবাদপত্র জগতে বেশি করে তৈরি করা জরুরি। কোমরের জোড়, কোয়ালিটি, আর্থিক ক্ষমতা, কারও ওপর নির্ভরতা নয়, সাহস এবং সত্যের প্রতি নিষ্ঠা। এই বিষয়গুলো থাকলে হয়তো সংবাদপত্র তার প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে পারবে।
কিন্তু আমাদের দেশে এখন যেটা হয়েছে, যে কোনো লোক যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করলে গণমাধ্যমের মালিক হতে চাইছে। সাংবাদিকতার কমিটমেন্টের জায়গা থেকে নয়, আমি অর্থ পেয়েছি, বাড়তি উদ্বৃত্ত অর্থ আছে, সেটা রক্ষা করার জন্য একটা ছায়া বা হাতিয়ার হিসেবে নিজ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে তারা ব্যবহার করছে। এ জন্য পলিটিক্যাল ইকোনোমির দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে বলব, সে রকম সংবাদপত্র আমাদের দরকার, যারা সাংবাদিক এবং সম্পাদক, তারা এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। সমবায়, শেয়ার হোল্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছেন, সেই শেয়ার হোল্ডিং কোম্পানির যিনি ডিরেক্টর, তিনি নিজেও একজন সাংবাদিক এবং সম্পাদক। সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে, শেয়ার হোল্ডারদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা হবে পেশাগত, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মতো।
একই সঙ্গে সেই সাংবাদিকের সাহস থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেই ন্যূনতম ব্যালেন্সটা তার পক্ষে থাকতে হবে। যেটা তাকে প্রোটেকশন দেবে।