আবেদন হারাতে চলেছে গণমাধ্যম?
সাংবাদিক কাজলের দুই হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা একটা ছবি যেবছর মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে সবার সামনে এসেছিল, সেবার এই ভাবনাটাই অনেকের মনে বদ্ধমূল হয়েছিল যে- এটাই বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রকৃত রূপ। এখানে শত শত গণমাধ্যম আছে ঠিকই, তবে তা সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের বা পরিবেশনের জন্য না। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায় রাজনৈতিক প্রভাব বাদ দিলেও করপরেটোক্রেসির প্রভাব প্রবল। আমরা শুধু সেইসব খবরই গণমাধ্যমে শুনতে পাই যা আমাদেরকে শোনানো হয়। তাই তো এই কিছুদিন আগেও যিনি থাকেন শুদ্ধাচারের প্রতীক, কিছুদিন পরে হয়ে ওঠেন দেশ সেরা দুর্নীতিবাজ। অথচ এরা কেউ আমাদের অচেনা নন, এদের কারো আচার-আচরণ সম্পর্কে আমরা কম অবগত নই, কিন্তু গণমাধ্যম এবং এর কর্মীরা সব জেনেও চুপ করে থাকেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদেরকে এই বিষয়ে বা এদের বিষয়ে কোনো কিছু অবমুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়! আর তাই তো গত ৩রা মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৪ সালের সূচকে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় আরও দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম, স্কোর ২৭ দশমিক ৬৪। এই সংস্থার মূল্যায়নে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থান আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সব দেশের নিচে। একদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অন্যদিকে গণমাধ্যমের মালিকানা কর্পোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণে- সেখানে পরিস্থিতি এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে এই ভয়ের পরিবেশ এক-দুই দিনে তৈরি হয়নি, এই সংস্কৃতি দীর্ঘ দিন ধরে তৈরি হয়েছে, যার চূড়ান্ত রূপ হয়ত এখন আমাদের সামনে! কিন্তু এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? ম্যাক্সওয়েল ই ম্যাককমস এবং ডোনাল্ড এল শ’র ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘গণমাধ্যম যদি জনগণের মনোযোগ নির্দিষ্ট বিষয়ের দিকে চালিত করতে পারে, তাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে, তাহলে ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতাও তাদের রয়েছে।’
মূলত সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম যেসব কারণে হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য হয়, তার সব ধরনের উপাদানই আমাদের দেশে বিদ্যমান। তারপরও কয়েক দশক ধরে সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পেরেছে। প্রায়ই নতুন নতুন পত্রিকা বা ওয়েব পোর্টালের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! অনেকেই মনে করেন, করপোরেটোক্রেসির যুগে গণমাধ্যম মূলত একটা ব্যবসায়িক মডেল। অন্য আর দশটা ভোগ্যপণ্যের মতো। গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা থাকলেও, এখন যেন সে কথা আর খাটে না।
মূলত জনগণের অনুশাসন চলে গেছে করপোরেট শ্রেণির হাতে। গণতন্ত্রের খোল নলচেও পাল্টে গেছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় যখন পরিবর্তন আসে, তখন করপোরেট অনুশাসনে চলা গণমাধ্যম আর কতটা চতুর্থ স্তম্ভের দায়-দায়িত্ব পালন করতে পারে সে ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়েই যায়। তার ওপর ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’-এর সময়কালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কবলে গণমাধ্যমকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নতুন আরেক বাস্তবতা। আর তা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। একে প্রযুক্তির এক নিষ্ঠুর রসিকতাই বলা যায়। যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যম পাঠকের আস্থার জায়গা হারাচ্ছে, তাহলে কি গণমাধ্যমের স্থান দখল করে নিচ্ছে টেকনোলজি বা সামাজিক মাধ্যম! কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যম নতুন কিছু নয়। প্রাক-শিল্পবিপ্লব যুগে মানুষের মুখে মুখে খবর ছড়াত, হাট-বাজারে লোকরা নিজেদের মতো একটা মতপ্রকাশ করত এবং নিজেদের সামাজিক একটা পরিমণ্ডল তৈরি করে নিত। শিল্পবিপ্লবের আগে জার্মানিতে মার্টিন লুথারের (১৫১১) ধর্মীয় প্রচার পুস্তিকা ষাট লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছিল। পুরো জার্মানিতে এই প্রচার পুস্তিকাগুলো বিক্রি হতে সময় লেগেছিল প্রায় দুই সপ্তাহের মতো। লুথারের সমর্থকরা এই পুস্তিকাগুলোর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। থমাস পেইনের প্রচার পুস্তিকা ‘কমন সেন্স’ (১৭৫৭) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশীকরণবিরোধী আলোচনা প্রচার করত। কিন্তু এর প্রচার সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। হাজারখানেকের বেশি নয়। এত স্বল্পসংখ্যায় প্রচার হলেও তা জর্জ ওয়াশিংটনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমানকালেও প্রযুক্তির মাধ্যমে জনগণ একই কাজ করছে। তবে পার্থক্য একটা আছে। তা হলো প্রাক-শিল্পযুগে সামাজিক মাধ্যম ছিল মানুষের সংযোগ স্থাপনের বিনাপয়সার উপায়। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগমাধ্যম গণমাধ্যমের জন্য হুমকি হয়ে ওঠার পাশাপাশি ভাগ বসাচ্ছে গণমাধ্যমের মুনাফায়ও। এ সম্পর্কে ক্রেগ নিউমার্ক বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া নতুন কিছু নয়। জন লক, থমাস পেইন এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে তিনি আধুনিক ব্লগারদের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং তিনি বলেছেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে মিডিয়া ও রাজনীতি হবে ভিন্নতর। কারণ ক্ষমতায় অভ্যস্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নেটওয়ার্কের দ্বারা পরিচালিত হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গোপন প্রচার-প্রচারণার মাধ্যম তার নিজ নিজ বলয়ে হয়তো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তাই বলে গণমাধ্যম তার আবেদন হারাবে বলে মনে হয় ন।’
প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ধরনের নিউজ পাওয়া যায়, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় খবরের উৎস অস্পষ্ট থাকে। আর দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে খবর প্রচার হয়, সেগুলো পরে পর্যালোচনা করার মতো উপাত্ত থাকে না। আবার মূলধারার গণমাধ্যমে যতগুলো ইস্যু একসঙ্গে পাওয়া যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় কিন্তু তা পাওয়া যায় না। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও হালকা ধরনের খবর প্রচারের কারণে ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটা বাজার তৈরি করেছে, যা গণমাধ্যমের প্রচারের ওপর তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সম্পাদনা, বিশ্বাসযোগ্যতা, নানাবিধ কারণে সবশেষে মানুষ গণমাধ্যমের ওপরই বিশ্বাস করতে চায়। যে কারণে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো একটা খবর কেউ প্রচার করলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত হতে মানুষ পত্রিকার লিংক চায়। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্যগুলোর কোনো বৈধতা নেই। বস্তুনিষ্ঠতার জন্য মানুষ মূলত এটাকে ব্যবহার করে না।
সোশ্যাল মিডিয়া মূলত সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য বা কোনো মতামতকে সংগঠিত করার জন্য ভালো। হাফিংটন পোস্ট বা উইকিলিকসের উত্থানের পর তথ্যপ্রবাহের জগতে নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম হয়তো কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, কিন্তু সর্বোপরি সংবাদমাধ্যম এখনো তার আবেদন হারায়নি। তবে এ কথা সত্যি, সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গত তিন দশকে গণমাধ্যমের ব্যবহারের ধারণায় বিপ্লব হয়েছে। মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অনলাইন সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাই বলা যায়, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের আবেদন ফুরাবে না। তাই তো সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক উত্থানের পরও সংবাদপত্র মালিক, করপোরেট লিডার ও রাজনৈতিক প্রভাবের দ্বারা পরিচালিত হলেও কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম এখনো তার আবেদন হারায়নি। বরং সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। একই সাথে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যত দিনে দিনে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক