ভারতের নির্বাচন ও দেশটির বাংলাদেশ-নীতি
ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর বিষয়টি পর্যবেক্ষকদের সামনে একটি বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। দেশটির একটি অংশের মানুষ ভারতের নির্বাচন ও তার ফলাফল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। এটা স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশে দেশটির প্রভাব ব্যাপক এবং বিষয়টির মাত্রা এত বড় যে, ধরে নেওয়া হয় গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে যখন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের খড়্গ উত্থিত হয়েছিল, তখন বিজেপি সরকার আওয়ামী লীগের হয়ে বাইডেন প্রশাসনের কাছে দেন-দরবার করেছিল। যার একটি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা বন্ধুরা পিছু হটতে বাধ্য হয় বলে অনেকে মনে করেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এরকমই তখন বলেছিলেন।
ভারত আমেরিকাকে ম্যানেজ করে ফেলবে এরকম কথাবার্তা গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লিগের নেতারা হরহামেশা বলতেন। ধারণাটা একেবারে নতুনও না। এর আগেও ২০১৪ সালে ভারত তার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল আপাতভাবে গররাজি জাতীয় পার্টি নেতা এইচ এম এরশাদকে ম্যানেজ করতে। ওনার মিশন মনে হচ্ছিল যে কোনভাবে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করিয়ে নির্বাচনকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া।
যে কারণে দেশে-বিদেশে অনেকেই মনে করেন, ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশি দিন টিকতে পারবে না।
তবে ভারতের এই নির্বাচনের ফলাফল একটা অবাক করা বিষয় নানাবিধ কারণে। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় যে বাবারী মসজিদ ধ্বংসের হাত ধরে দলটির উত্থান, সে মসজিদের জায়গায় দলটি সাফল্যের সাথে রামমন্দির নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
শুধু তা নয়, এ কাজটি করার মধ্য দিয়ে দলটি ভারতের জনবহুল প্রদেশটি এবং সাধারণভাবে হিন্দুপ্রধান ভারতে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গিয়েছে বলে অনেকে মনে করতে শুরু করেছিলেন।
মোদি ম্যাজিকের কথাও নির্বাচনের প্রাক্কালে ব্যাপক শোনা যাচ্ছিল। এমনকি যখন একটির পর একটি জনমত জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো ক্ষমতাসীন এনডিএ-র জন্য ভূমিধস বিজয়েরই পূর্বাভাস দিয়েছে।
এখন আমরা নির্বাচনের ফলাফল জানি। আমরা এও জানি ভারতীয় রাজনীতিবিদরা আগামী কিছুদিন ক্ষমতার করিডরে দর–কষাকষিতে ব্যস্ত থাকবেন। বিজেপির কোয়ালিশনের দুইটি দল আপাতভাবে মোদি সরকারকে সমর্থন দিলেও পাশার দান উল্টে যাওয়ার ঘটনা কাউকে অবাক করবে না।
বাংলাদেশ ও তার রাজনীতির জন্য এ বিষয়গুলো কী প্রভাব ফেলবে, এটা স্বাভাবিকভাবে অনেকেই ভাবছেন।
প্রতিবেশী-নীতির ক্ষেত্রে ভারতের একটি হ্রস্ব দৃষ্টি রয়েছে বললে তা বাতুলতা হবে না। দেশটির জন্মের পর থেকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি প্রায় এক ছিল। মনমোহন সিংহ এসে অর্থনীতির উদারীকরণ করলেও প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে দেশটি পূর্বের নীতিতে প্রায় অবিচল রয়েছে এটা সহজেই বলা যায়।
আশপাশের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সাথে যুক্ত। এ রাজ্যগুলো বেশ কয়েক দশক ধরে একটি বিদ্রোহ-বিপর্যস্ত অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। এইসব কাজের জন্য ভারতের দক্ষিণ ব্লক, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর দফতর, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগের কাছে কৃতজ্ঞ বলে মনে হয়।
শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে আর্থিক, সামরিক ও অন্যান্য এমন সব সুবিধা দিয়েছে যা দেশটি এই অঞ্চলের অন্য কোনো দেশ থেকে কমই পেয়েছে।
চীন ও পাকিস্তানের সাথে বৈরী সম্পর্কের পাশাপাশি ক্ষুদ্র মালদ্বীপে মোহাম্মদ মইজ্জু ও তার দল প্রগ্রেসিভ পার্টি অফ মালদ্বীপের উত্থান ভারতকে বিচলিত করেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে নেপাল, ভুটান ও দীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাতে ভারত বিরোধিতার হাওয়া।
মিয়ানমারে ভারত-সমর্থিত সামরিক সরকার যুদ্ধের ময়দানে তেমন সুবিধা করতে পারছে না। আরাকান আর্মি যদিও বলেছে তারা অঞ্চলটিতে ভারতের করা 'কালাদান প্রোজেক্ট’ চালু রাখবে— শেষ বিচারে দলটি এই ওয়াদা কতটুকু পালন করবে তা কেবল সময়ই বলতে পারবে।
সত্যি কথা বলতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের কাছে আওয়ামী লীগ সরকার কিছুটা হারাধনরের শেষ ছেলেটির মত, যাকে কষ্ট দেওয়া দূরে থাক একটু চোখের আড়াল করাও মুশকিল।
বিজেপি যদি সরকার গঠন করতে না পারে বা বছর দুয়েক পর ক্ষমতা হারায়ও, ভারতের আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন নিরবচ্ছিন্ন থাকবে এটা মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়।
আফসোসের বিষয় হচ্ছে ভারত, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলে বিশ্বের সামনে নিজেদের হাজির করে, তারাই নিজের আঙ্গিনাতে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগকে সংকুচিত করতে কোন সমস্যা দেখে না। শুধু দেখে না যে তা নয়, এই সংকোচনের পেছনে উদার হস্তে কাজ করে যায়।
এএম হুসাঈন: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক ও সাংবাদিক।