‘গোদি’ মিডিয়ার বুথফেরত জরিপের ভূতেরা
ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর বুথফেরত জরিপ হাস্যরসের তৈরি করেছে। বুথফেরত জরিপের পর বাস্তবে যে ফলাফল এসেছে, তা পুরো উল্টো। মোদি বিরোধী জোট যেহেতু দুটি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, এখানে ক্ষমতাসীনদের ভাগ্য অনেকটা ঝুলে গেছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বুথফেরত জরিপ এতটা ভুল হলো কিভাবে?
ভারতের লোকসভা নির্বাচন, বিশ্বের বৃহত্তম নির্বাচন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে সাত ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে এটি। প্রায় এক বিলিয়ন ভোটার ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছিল। এটি স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে সভা-সমাবেশে তিক্ত ও রূঢ় মন্তব্য করতে ছাড়েননি। তাকে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
এপ্রিলে রাজস্থানে দেওয়া এক বক্তৃতায় মোদি বলেছিলেন, ‘...যদি কংগ্রেস সরকার গঠন করে প্রত্যেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে। তাদের গয়না, সোনা এবং রুপা মানুষের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হবে।’
মোদি এও বলেছিলেন, বিরোধীরা (হিন্দু) ভোটারদের টাকা নেবে এবং যাদের বেশি সন্তান রয়েছে তাদের দেবে। অবৈধ অভিবাসীদের কাছে... তারা তাদের মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করবে...।
শুধু মুখের বুলি নয়, মোদির গলার স্বর এবং তার মুখভঙ্গিতে যা দেখা গেছে সেটিও আমাদের নজর এড়ায়নি। তাকে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা গেছে, যেন তিনি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিলেন সেখান থেকে উঠতে আসার প্রাণান্ত চেষ্টা দেখা গেছে।
যখন একজন ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে মুসলমানদের আলাদা করে রাখা কিংবা তাদের অভুক্ত রাখার মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়, তখন তারা দিনের শেষে পরেরটিেই বেছে নেবে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের চেয়ে ভারতে এখন বৈষম্য দানা বেধেছে চরমে। দেশটি অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত; যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বেকারত্ব, জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়া এবং অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা। এগুলো বাস্তব সমস্যা। শুধু ঈশ্বরের নাম জঁপলেই হবে না, এসব সমস্যার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নরেন্দ্র মোদি যখন তার গদ্য উত্থাপন করেছেন, তখন তার পোষা গণমাধ্যমগুলো- যা গোদি মিডিয়া নামে পরিচিতি পেয়েছে; তারা সংবাদ আকারে এবং মতামত প্রকাশ করে একের পর এক গীতিনাট্য রচনা করেছে। যার শেষটি জনমত জরিপ বা যাকে আমরা বলছি বুথফেরত জরিপ।
এটা স্পষ্ট যে শেষ ব্যালটটি দেওয়ার আগেও মোদি অন্তরে অনুভব করেছেন যে তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সবার সামনে নত হবে। অর্থাৎ, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে এটা মোদি বুঝতে পেরেছিলেন।
এরপরেও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বিজেপির একক বিজয়ের আভাস দিতে থামেনি। ইন্ডিয়া টুডে একটি গ্রহণযোগ্য ও বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমটি বুথফেরত জরিপে বলেছিল, বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) ৩৬১ থেকে ৪০১টি আসন পাবে। যদিও বাস্তবতা বলেছে ভিন্ন কথা। এনডিএ মোটে জিতেছে ২৯২টি আসনে।
ভারতে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন হয় ২৭২টি আসনের। নিউজ২৪ তো আরও একধাপ এগিয়ে। তাদের পূর্বাভাস ছিল এনডিএ ৩৮৫টি থেকে ৪১৫টি আসন পাবে। তারা বিরোধী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পক্ষে রেখেছিল ৯৬-১১৮টি আসন।
এছাড়া ইন্ডিয়া টিভির বুথফেরত জরিপে ৩৭১ থেকে ৪০১টি আসনে বিজয়ীর আভাস দিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকে ক্ষমতায় দেখেছিল।
এক্সিট পোলে সবসময় মারাত্মক ধরনের ভুল তথ্য উপস্থাপনের সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে বাদ যায় না পশ্চিমারাও। সেখানেও এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে প্রভাবশালী গণমাধ্যমকে বিকৃত তথ্য প্রচার করতে হয়েছে।
তবে ভারতীয় গণমাধ্যমকে একটু আলাদা করতেই হবে। ২০১৯ সালে মোদি সরকার প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অন্যান্য বিজ্ঞাপনে দৈনিক ১.৯৫ কোটি রুপি ব্যয় করেছে। যদিও সরকারের বিদেশি গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় জানা যায়নি।
এক্ষেত্রে ক্ষমতার ব্যবহার এবং ব্যবসায়িক সুবিধার দেওয়ার প্রলোভনও কাজ করে। খারাপ খবর মাঝে মাঝে চাপা পড়ে যায়। তবে এই সংকট বেশ প্রকট বলেই ধরে নিতে হয় যখন কোভিড মহামারির সময় টাইম ম্যাগাজিন একটি শিরোনামে বলেছিল, ‘এটি শুধু মোদির একার নয়, ভারতের মিডিয়াকেও কোভিড-১৯ সংকটের দায় নিতে হবে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষার নিউজ চ্যানেল, সেই সাথে আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমগুলো চরমভাবে মোদিপন্থী। তারা নিয়মিতভাবে সরকারের সাফল্যগুলোকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করেছে। এক্ষেত্রে তার ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। বিরোধী, উদারপন্থী, মুসলিম, অ্যাক্টিভিস্ট, বামপন্থী, প্রতিবাদকারী, এনজিও এবং অন্যান্য বিভিন্ন “জাতীয় বিরোধী”-দের এড়িয়ে কোনঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আজ ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ অনুতপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে। তাদের বুথফেরত জরিপ বড় ধরনের ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এই সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেভাবে কাজ করেছে তা বিচার করে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে যে এই ভুল অনিচ্ছাকৃত নয়। বরং তারা প্রভুর তুষ্টির জন্যই এমনটি করেছে।
ভারতীয় সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলের একটি অংশ নির্বাচনের সংবাদ কাভারেজ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের গণমাধ্যম হিসেবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সাংবাদিকতায় তাদের অবস্থান আরও পেশাদারিত্বের সঙ্গে হোক এটি প্রত্যাশা করা হলেও বারবার হতাশ হতে হয়েছে।
তবে ইতিহাস বলছে, সাংবাদিকতা দীর্ঘমেয়াদে এভাবে চলার সুযোগ নেই। এমনটি হয়নি আর কখনও হবেও না।
লেখক: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক ও সাংবাদিক