শিক্ষায় স্বল্প রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে মানসম্পদ তৈরি করা যাবে না
জাতীয় বাজেটের মধ্যে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন নিহিত থাকে। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেখানে দুইটি বিষয়ে চিন্তার কারণ রয়ে গেছে। প্রথমত, বাজেটে শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বেড়েছে গতবারের থেকে। কিন্তু আমাদের মোট যে পরিমাণ শিক্ষার্থী রয়েছে, যে পরিমাণ শিক্ষার্থী বেড়েছে, সেই অনুপাতে বরাদ্দ বাড়েনি। অর্থাৎ শিক্ষার্থী প্রতি বরাদ্দ বাড়েনি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাবসহ শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ জায়গায় দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে সেসব প্রকল্প বন্ধ হয়ে আছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে আমরা দেখেছি সিলেট বোর্ডে ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংকট বা শিক্ষকদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে এমনটা ঘটেছে।
বাংলার শিক্ষক যদি ইংরেজি বিষয়ে পড়াতে যান তখন এমন অবস্থাই তো হবে। এখানে শিক্ষকদের দায়ী করে লাভ নেই। নতুন শিক্ষাক্রম খুব দ্রুত চালু হয়ে যাবে। ফলে এই নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের খাপ খাইয়ে নিতেও এক ধরনের সংকট তৈরি হবে। এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় মানসম্মত প্রশিক্ষণ। কিন্তু চলতি বাজেটে এই জায়গাটাতে গুরুত্ব দেওয়ার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলে দেখা যায়।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা অনেক বছর ধরে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এবারের বাজেটেও তার প্রতিফলন হয়নি। অঙ্কের হিসাবে বরাদ্দ বেড়েছে, বাস্তবে বাড়েনি। টেকসই উন্নয়নের লক্ষে শিক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশ বা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করবে এ রকম প্রতিশ্রুতি ছিল সরকারের। তা এখনও রক্ষা হয়নি। শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলে একটি খাতে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়। যা হওয়া উচিত নয়।
শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষা খাতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয় তা আসলেই গতানুগতিক। এখানে নতুনত্ব আনা জরুরি। যত কিছুই করি না কেন, শিক্ষার মান উন্নয়ন ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ না করলে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আছে জিডিপির মাত্র ১.৬৯ শতাংশ। যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকার কথা। আমাদের বুঝতে হবে, শিক্ষায় বরাদ্দ কোনো খরচ নয় বরং বিশাল বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করে।
যেসব দেশ এটা বুঝতে পেরেছে, সেসব দেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতা, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সহায়ক সমাজ গড়ে তুলতে হলে সময়োপযোগী শিক্ষা প্রদান করতে হবে। এ জন্য দরকার শিক্ষা বা গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি আবশ্যক।
গবেষণা খাতে এবারও আমরা তেমন বরাদ্দ দেখিনি। অথচ প্রধানমন্ত্রীর নিজেও বারবার গবেষণার কথা বলছেন। আমরা দেখেছি, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। আমরা এক ধরনের কৃষি বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু শিক্ষা গবেষণায় আমরা সেই বিনিয়োগটা দেখি না। ফলে আমরা শ্রেণিকক্ষের ভেতরে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী যে পাঠদানে সম্পৃক্ত থাকেন তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য সুযোগ সুবিধা ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য যে উপবৃত্তি দেওয়া হয় সেটা বাড়ানো হলো না। এটা দুঃখজনক। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে হলেও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বাড়ানো প্রয়োজন। পাঁচ বছর আগের উপবৃত্তি এখনও যদি একই পরিমাণ থাকে সেটা অন্যায্য। উপবৃত্তি দেওয়া হয় দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের। এই মেধাবীরাই একদিন দেশের জনসম্পদে রূপান্তরিত হয়।
রাশেদা কে চৌধুরী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক