অবৈধ অর্থনীতি বড় করার বাজেট
সরকার বাজেটের আকার সীমিত রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি অনুযায়ী এবার ব্যয় সাশ্রয়ী বাজেট হওয়া উচিত ছিল। বাজেটে যে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা অর্জন করা কঠিন হবে। বাজেটে বড় ঘাটতি রয়ে যাবে, যা অতীতে দেখা গেছে।
আর এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে ঋণ নির্ভর হয়ে যেতে হচ্ছে। যা বড় দুশ্চিন্তার কারণ। যে ব্যাংকিং সেক্টরের এত দুরবস্থা, এত সংকট ও সংশয়, সেই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে হয় না।
ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, ডিপোজিট কমছে। সেই ব্যাংক থেকে সরকার টাকা নিলে ব্যক্তি খাত বা প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঋণ পাবে না। ঋণ না পেলে তার বিনিয়োগ করতে পারবে না। এতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কর্মসংস্থান নষ্ট হবে। আর কর্মসংস্থান না থাকলে সরকার কর আদায় করবে কোথা থেকে!
এ ছাড়া প্রাইভেট সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশে পণ্যের সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সরকার যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, তা সম্ভব হবে না।
বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব যথাযথ নয়। বাজেটে ৯০ হাজার কোটি টাকা বিদেশি ঋণের কথা বলা হয়েছে। এমনিতেই আমাদের বৈদেশিক ঋণ অনেক বেড়ে গেছে এবং যে পরিমাণ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রতিবছর, তাতে বাজেটের উপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে। তার ওপর আবার বিদেশি ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করি না। বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকলে সামনে ঋণ পরিশোধ এবং সুদের চাপ বড় সংকট হিসেবে দেখা দিতে পারে।
২০২৪-২৫ বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন বরাদ্দে এত টাকা বাজেট রাখার কোনো দরকার ছিল না। এখন আমাদের দরকার আইটি সেক্টরে বিনিয়োগ এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক উন্নয়ন। আমাদের দরকার উৎপাদনমুখী খাতে ব্যয় করা। এখন বিপুল ভৌত অবকাঠামোর প্রয়োজন নেই।
নতুন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল নির্মাণ, জেলা পরিষদের ভবন করা— এসব এখন দরকার ছিল না। আমি মনে করি উন্নয়ন বাজেট ২ লক্ষ ৬৫ হাজারের জায়গায় এক বা দেড় লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে করলে ভালো হতো।
বাজেটে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে জনপ্রশাসন ও ঋণের সুদাসল পরিশোধে। বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করে ফেলার সুযোগ রাখা হয়েছে। যেখানে সর্বোচ্চ করের হার ৩০ শতাংশ, সেখানে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাচ্ছে। এটা একদমই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এই সুযোগের ফলে মানুষ আরো দুর্নীতি করতে উৎসাহিত হবে। মানুষ ভাববে আমি কালো টাকা রাখলেই ভালো। ১৫ শতাংশ কর দিয়ে মাফ পেয়ে যেতে পারবে মানুষ।
আমি মনে করি, কালো টাকা সাদা করতে কমপক্ষে ৩০-৪০ শতাংশ কর ধার্য করা দরকার ছিল। একটি নির্দিষ্ট সময় পর এই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
ওপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়া বাজেটে তেমন লক্ষণীয় আর কিছু নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তা কীভাবে করা হবে তার কোনো পরিকল্পনা নেই। কোন সুনিশ্চিত পদক্ষেপ নেই। রিজার্ভ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তা কীভাবে বাড়ানো হবে, তার পথ নিদের্শনা নেই। বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু দেশের মানুষের কাছে অর্থ না থাকলে বিনিয়োগ কোথা থেকে হবে? দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্র অনুকূল না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ কীভাবে আসবে?
নানা ধরনের অনিশ্চয়তা, গ্যাস বিদ্যুতের জোগান ঠিকমতো নেই, জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে ঝামেলা, এ ছাড়াও এনভায়রনমেন্ট ক্লিয়ারেন্স, পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসহ দশ ঘাটে যেতে হয়। এত জটিলতার মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো কীভাবে আসবে ইত্যাদি প্রশ্নের কোনো উত্তর বাজেটে নেই।
রিজার্ভ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগ না বাড়লে সেটা সম্ভব নয়। রেমিটেন্স বাড়ানো যাচ্ছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্যের কারণে। বৈধ পথে যত রেমিটেন্স দেশে আসে, তার থেকে বেশি আসছে হুন্ডিতে। আর হুন্ডিতে টাকা আসা মানে প্রকৃতপক্ষে ডলার পাচার হয়ে যাওয়া। সম্প্রতি আমাদের রপ্তানিও কমেছে। ফলে রিজার্ভ বাড়ার কোনো পথ দেখছি না।
দেশের ব্যাংকগুলোতে লক্ষ লক্ষ টাকা খেলাপি ঋণ। কিন্তু এই খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারের। দেশের আর্থিক খাতে সার্বিক যে বিশৃঙ্খল অবস্থা, তাতে কোনোভাবে করের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ বা ভ্যাট কোন কিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতের সংস্কার দরকার।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর