কোরবানি ও উৎসবের অর্থনীতি
‘মাংস বা রক্ত কোনোটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, পৌঁছায় তোমার মনের পবিত্র ইচ্ছা।’
-আল কোরআন
ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই ঈদ প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ হাজির হয় মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করার বার্তা নিয়ে। ত্যাগের আনন্দে উদ্ভাসিত পবিত্র ঈদুল আজহা মানুষকে মানবিক চেতনায় পুষ্ট হয়ে জগতের সকল সৃষ্টির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার শিক্ষা দেয়। উৎসাহ যোগায় সাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হতে।
ঈদ উৎসবে উৎসর্গের সব আয়োজন-আপ্যায়নের মর্মবাণী হলো, সামাজিক সমতা-সখ্যতা বৃদ্ধি এবং সম্পদ, সুযোগ ও সৌভাগ্যের বণ্টন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা। ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যে উৎসবে দারুণ প্রাণচাঞ্চল্য লাভ করে তার মধ্যে দুটো ঈদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঈদে অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ, শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। এ উৎসবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অর্থ লেনদেনসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
কোরবানির ঈদে জামাকাপড়ের ব্যবসা তেমন হয় না। মূলত কোরবানিযোগ্য পশু, আদা, পেঁয়াজ, রসুনসহ সব মসলা, দুধ, চিনি, সেমাই, পোলাও চাল, আটা ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ই মূলত হয়ে থাকে। তবে বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও বাংলাদেশে ঈদুল আজহায় বাদ সেধে চলেছে বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনীতিতে, বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে চলমান মূল্যস্ফীতির সংকট, কেননা এ দেশের সিংহভাগ মানুষ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বলয়ে, এখানে উচ্চবিত্তের সঙ্গে মধ্য ও নিম্নবৃত্তের আনুভূমিক ও উল্লম্ব সম্পর্কের দূরত্ব সাধারণ সমীকরণ ও সূচকের ধারে কাছে নয়। ঈদুল আজহা আয়-উপার্জনের জন্য মুখিয়ে থাকা দেশের অধিকাংশ মানুষকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পশু কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ঈদুল আজহায়। পরিসংখ্যান ব্যুরার হিসাব মতে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ গরু ও ৭০-৭৫ লাখ খাসি কোরবানি হয়। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ)-এর মতে, ২০২৩ সালে ৮০-৮৫ লাখ গরু ও ৭০ লাখ খাসি কোরবানি হয়। গরুপ্রতি গড় মূল্য ৬০ হাজার টাকা দাম ধরলে এই ৮৫ লাখ গরু বাবদ লেনদেন হয়েছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা এবং ৭০ লাখ খাসি (গড়ে ৮০০০ টাকা দরে) ৮ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ পশু কোরবানিতে প্রায় ৪০-৪২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রায় ৬,০০০ কোটির টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় এ খাতে। কোরবানিকৃত পশু সরবরাহ ও কেনাবেচার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চাঁদা, টোল, বখশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাঁসিল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া, বাঁশ খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও মাংস প্রস্তুতকরণ এমন কি পশুর সাজগোজ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফর্মাল-ইনফর্মালওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কোরবানিকৃত পশুর চামড়া আমাদের অর্থনীতিতে, রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে, পোশাক ও হস্তশিল্পে অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ১৬০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৮০-১০০ কোটি টাকা।
তবে এই উৎসবের অর্থনীতিতে কিছু সমস্যাও পরিলক্ষিত হয়। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত থেকে অবৈধ উপায়ে গরু আনা, ব্যাপক হারে জাল টাকার দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়া, পকেটমার-অজ্ঞান বা মলম পার্টির কাছে গরু বিক্রেতাদের সর্বস্ব হারানো, চামড়া পাচার, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়া বিক্রয় ইত্যাদি সমস্যা প্রতিবার ঘটলেও সমাধানে আন্তরিকতা কোনোবারই দেখা যায় না। এ ছাড়া গরুবোঝাই ট্রাকে নিয়মিত চাঁদা তোলার অভিযোগ বেশ পুরোনো।
চামড়া নিম্ন দামে পাচার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেটের কবল থেকে চামড়া ব্যবসাকে উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। দেশে নিজস্ব চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং উপযুক্ত মূল্যে তা রপ্তানির প্রণোদনা সৃষ্টি করেই এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি লাভ ঘটতে পারে। লবণ চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান। ২০২৩ সালে সরকারকে ২০-২৫ হাজার টন লবণ শুল্কমুক্ত আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়েছিল যাতে সিন্ডিকেট করে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা না হয়।
কোরবানির পশুর মাংস আমিষ জাতীয় খাদ্যের উপাদান এবং এই মাংসের বিলি-বণ্টন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বছরের একটি সময়ে সবাই আমিষপ্রধান এই খাদ্যের সন্ধান/সরবরাহ লাভ করে থাকে। মাংস রান্নার কাজে ব্যবহৃত মশলা বাবদ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে এ সময়ে। মশলার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে ঈদ উদযাপনের ব্যয় ব্যবস্থাপনাকে কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করায়। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল শুধু মিয়ানমার থেকে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার মশলা অবৈধভাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশে।
এ সময় লেনদেনে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে, তারল্য সংকটে পড়ে যায় আর্থিক খাত, কলমানি মার্কেট থেকে চড়া সুদে ধারকর্জে নামে ব্যাংকগুলো। চামড়া খাতে ঋণ থেকে শুরু করে ঈদের বোনাস বাবদ বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এগিয়ে আসতে হয়। এ অবস্থায় জাল নোট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন নোট সরবরাহে নামতে হয়। মোদ্দা কথা, হজ ও কোরবানি উপলক্ষে মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থায় যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় ব্যাংকিং খাতে তা তারল্য সংকট সৃষ্টি করে এবং কলমানি মার্কেটে সুদের সূচকের ওঠানামা দেখে তা আঁচ করা যায়। এ সময়ে অবধারিতভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়। তবে এবার অর্থনীতি মন্দার কবলে থাকার প্রেক্ষাপটে পশু বিপণন ও কোরবানি, চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ সব ক্ষেত্রেই হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজমান।
সামাজিক ঐক্য ও সংহতি আরো মজবুত হয়।কোরবানির মাংস গরিব আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ। গরিবরা কোরবানির মাংসের মাধ্যমে তাদের আমিষের চাহিদা কিছুটা পুরণ করতে পারে। কোরবানির দিন পরিশ্রমী গরিব মানুষের চাহিদা থাকে অনেক বেশি। তারা সামর্থ্যবান ধনীদের কোরবানির গোস্ত কেটে দিয়ে নগদ পয়সা উপার্জন করে। উপরন্তু তারা অতিরিক্ত কিছু গোস্তও পায়। ঈদের দিনে তাদের একদিকে আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়, অপরদিকে গোস্ত খাওয়ার তথা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো খাবারের আয়োজনেরও সুযোগ হয়। দেশে যত বেশি কোরবানি হবে, তত বেশি গরু খামারির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। তারা গরুর ভালো দাম পাবে। দেশে গরুর লালন-পালন বাড়বে। কোরবানি বেশি হলে চামড়া শিল্পের বিকাশ দ্রুত হবে।
মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.)এর সুমহান ত্যাগের আদর্শকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুমিন মুসলমানের ওপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন। আমরা যেন ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর আদর্শ উজ্জীবিত হয়ে কোরবানি করতে পারি এটাই প্রার্থনা করি।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক ও গবেষক