বার্মার হুমকি ও আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা
বর্তমান বহুমুখি বিশ্বব্যবস্থার আঙ্গিকে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে নতুন আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। একদিকে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক মহাপরিকল্পনা যার অন্যতম চালিকাশক্তি ভারত এবং অন্যদিকে বার্মার আগ্রাসী সামরিক তৎপরতা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে নাজুক করে তুলেছে। এ অবস্থায় আপামর জনগণের সম্পৃক্ততায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে সুকঠিন ঐক্যের প্রয়োজন তা অনুপস্থিত থাকায় চ্যালেঞ্জটা অনেক বড় আকার ধারণ করেছে।
আমাদের নেতৃত্বের একটি বড় অংশ এতদিন মনে করে আসছিল যে, ভারতের সঙ্গে সুনিবিড় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় যে নতুন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সে ব্যাপারে তারা ভেবে উঠতে পারেননি। এখন সময় এসেছে এই সব নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সুদূরপ্রসারি চিন্তাভাবনা করার।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেউ কারো জন্য বসে থাকবে না। প্রত্যেককেই যার যার নিজের অবস্থান নিজেকেই তৈরি করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, সত্যই যদি বার্মা বাংলাদেশে বড় আকারে আক্রমণ করে বসে তাহলে ভারত কি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াবে? কিংবা আমাদের সামরিক সরঞ্জামের প্রধান উৎস চীন কি তার সীমান্তবর্তী বন্ধু বার্মার বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের পাশে থাকবে? যদি তারা নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের পাশে না থাকে তাহলে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে? এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট একটি চিন্তা-ভাবনা বা ন্যারাটিভের ভিত্তিতে সবকিছু দেখলে মারাত্মক ভুল হতে পারে, যার খেসারত দিতে হবে গোটা জাতিকে।
মনে রাখতে রাখতে হবে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ কোটিতে উপনীত হয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর বিগত ৫১ বছরে সাড়ে ১১ কোটি মানুষ সংযুক্ত হয়েছে। আর তাদের অধিকাংশ যুবক-যুবতী। আর তাদের দৃষ্টি সামনের দিকে, পিছনের দিকে নয়। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তির কারণে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা সম্পর্কেও তাদের ধারণা পরিষ্কার। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল পড়ুয়া বালকবালিকাও বৈশ্বিক ঘটনাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ফলে কায়েমী স্বার্থে পরিচালিত অতীতের স্লোগান নির্ভর রাজনীতির ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা এমন এক টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবে, যেখানে থাকবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা এবং যার সঙ্গে অতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক। এরকম একটি জাতীয় জীবনের সঙ্গেই জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমাদের সেনাবাহিনীও এধরনের একটি অখণ্ড জাতীয় সত্তা ভাবতে সক্ষম বলে আমাদের বিশ্বাস। আর এটা এখন ভাবতেই হবে। কারণ আমাদের সামনে রয়েছে কঠিন কঠিন সব চ্যালেঞ্জ। এটা সত্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা আমাদের বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী সত্যিকার অর্থেই জনগণের সেনাবাহিনী। কারণ পাকিস্তান আমলে শুধু শিক্ষিত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা অফিসার হিসাবে সুযোগ পেত। এখন আমাদের সেনা ও সিপাহীরা বাংলাদেশের যে কোনো পরিবার থেকে আসার সুযোগ পাচ্ছে, শ্রেণীগত কোনো ভেদাভেদ নেই। আর এভাবেই আমাদের সেনাবাহিনী জনগণের সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি পার্বত্য চট্টগ্রামে ইন্সার্জেন্স মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর অভূতপূর্ব সাফল্যে। পরে এ অভিজ্ঞতার করণেই জাতিসংঘের মিশনে আমাদের সেনাবাহিনী সফলতা প্রদর্শন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
যদিও বর্তমানে আমরা একপেশে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদীতায় জাতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু এ সত্যটাও আমাদের মানতে হবে, যেকোনো দেশে, যেকোনো সময়ে, যে কোনো পরিস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু আমাদের সামনে এখন যে প্রচলিত যুদ্ধের হুমকি বিরাজ করছে, তা মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে অধিকতর জনসম্পৃক্ততা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের ডক্ট্রিন কী হবে তা নির্ধারণও জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে শুধু বার্মার হুমকি নয় ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগরে পরাশক্তিরসমূহের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বহুমুখি জটিল লড়াইয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে সেটা নিয়েও ভাববার বিষয়টিও সামনে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট কায়েমী স্বার্থবাদী চিন্তাভাবনার চেয়ে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকবে পুরোপুরিভাবে।