ভারতকে রেল ট্রানজিট বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে এমন একটি বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে যেটি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
ভারতকে রেলপথে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এটি কার্যকর হলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ ও হলদিবাড়ির মধ্যে ভারতীয় ট্রেন চলাচল করবে। বাংলাদেশের জন্য এই প্রস্তাব মেনে নেওয়াটা নজিরবিহীন। কারণ, এর আগে দেশটির ইতিহাসে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার নজির নেই।
ভারতে পরিকল্পনা হলো উত্তরর-পূর্ব অঞ্চলের অশান্ত রাজ্যগুলোকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে খুব সহজে যুক্ত করা। যেটিই গতকাল রবিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ‘সেভেন সিস্টারস’ নামে পরিচিত ওই প্রদেশগুলোকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন (এক্সক্লেভ) বলা যেতে পারে। কারণ এই প্রদেশগুলো বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে ২২ কিলোমিটার এলাকার মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে পাঁচটি ‘অপারেশনাল ইন্টারচেঞ্জ’ পয়েন্টে ভারতীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত। যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিকভাবে রেল যোগাযোগ হয়। তবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে কোনো ভারতীয় ট্রেন সরাসরি চলাচল করে না।
ভারতে ট্রেন ট্রানজিট দেওয়া নানা কারণে উদ্বেগের। আমরা এখনও জানি না যে এই ট্রেনগুলো থেকে শুধুই বেসামরিক পণ্য পরিবহন করা হবে কি-না। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী কিংবা সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর আশঙ্কা থেকে যায়। এ কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বৈরিতা হবে। বিশেষ করে ভারতীয় ট্রেন যে এলাকায় যাবে সেটি ডোকলাম উপত্যকার কাছাকাছি; যেটি নিয়ে কিছুদিন আগেও ভারত ও চীনের সামরিক বাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে ছিল।
চীন এবং ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সামরিক সরঞ্জামাদি বহনকারী এই ট্রেন স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। শুধু তাই নয়, এটি বাংলাদেশকে এমন একটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করবে যা তার জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে খুব কমই সম্পর্কিত। চীন-ভারত সংঘর্ষ বাংলাদেশের মাথাব্যথা নয়, এমনটি কখনও ছিলও না, ভবিষ্যতেও এমনটি হওয়া উচিত হবে না।
এক্ষেত্রে ভারতকে রেল ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার যে ইতিহাসের কথা বলা হয় সেটির অবসান হবে। তখন বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক-কৌশলগত মিত্র হিসেবেই দেখা হবে। এটি বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার ভবিষ্যত অংশীদারিত্বের জন্য অশুভ ইঙ্গিত। সহজ কথায়, ভারত ও চীনের মধ্যে চলমান ভূ-কৌশলগত দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে দিল্লির পাশে দাঁড়াতে দেখা যাবে। আর সেটি কোনোভাবেই চীন ভালোভাবে নেবে না।
শুধু তাই নয়, ভারতের একটি অশান্ত অঞ্চলের জন্য ট্রেন ট্রানজিট দেওয়াটা মোটেই সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। এর জন্য একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে, ১৯৩১ সালে উত্তর-মধ্য চীনের মুকডেনে একটি মিথ্যা পতাকা অভিযান শুরু করে জাপান। ১৯৩১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাপানি সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট সুয়েমোরি কাওয়ামোটো নিজ দেশের ভূখণ্ডের দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেলওয়ের কাছে কিছু ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটান। এর কারণ, সুয়েমোরি চেয়েছিল এর জন্য চীনাদের দোষারোপ করা; যারা ওই সময় জাপানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। জাপান এটিকে একটি অজুহাত হিসেবেই শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করে এবং পূর্ণ আক্রমণ করে মাঞ্চুরিয়াতে জাপানি দখলদারিত্ব ঘটিয়ে এই অঞ্চলে একটি জাপানি পুতুল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে।
এক্ষেত্রে এ ধরনের ঝুঁকি তো বাংলাদেশের রয়েছেই। সীমান্তে ধারাবাহিকভাবে সাধারণ বাংলাদেশিদের হত্যা করছে ভারত; যেটি সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর পরেও বাংলাদেশ ভারতকে কেন এমন সুবিধা দিতে সম্মত হচ্ছে সেটি আসলে বোধগম্য নয়। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে গেলেই গুলি করে মারতে হবে- এটি কোনো সভ্য সমাজের আইনের চোখে বৈধ হতে পারে না। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এই ঘটনাগুলো এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়। এতকিছুর পরেও ভারত কখনও দুঃখপ্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
এখানেই শেষ নয়, ভারতের ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশিদের হেয় করেন। বাংলাদেশিদেরিউদাহরণ দিতে গিয়ে তারা তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলেন। এইতো ছয় বছর আগে এক নির্বাচনী জনসভায় ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রধান অমিত শাহ তথাকথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘এক ধরনের কীট’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
অমিত শাহের এই মন্তব্যকে আমরা বর্ণবাদী এবং জেনোফোবিক হিসেবে ধরে নিতে পারি। তবে হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক অবৈধভাবে যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ ভিসায় এসে কাজ করছেন, এটি কিন্তু আমাদের নজর এড়ায় না। এই বিষয়টি বাংলাদেশে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। কারণ দেশের স্থানীয় গ্র্যাজুয়েটরাই অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের দ্বারা নিজেদের চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এর পরেও বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক বিষয়গুলোকে আরও বিষাদময় করতে পটু ভারত; তারা বছরের পর বছর তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ঝুলিয়ে রেখেছে। ভারতের বড়ভাইসুলভ আচরণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এসব কারণেই দেশটিতে ভারত বয়কট আন্দোলন গতি পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা কেন ট্রেন ট্রানজিট প্রস্তাবে রাজি হলো তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত এই বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা। কারণ, পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতোই বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাও বিক্রির জন্য নয়।
লেখক: বার্মিজ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মী